Published :
Updated :
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে ভারত সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে বলা হয় টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য, এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতীক।
ব্যস! তারপরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টাঙ্গাইল শাড়িকে ঘিরে শুরু হয় তোলপাড়। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব ভারত লুফে নেওয়ায় শুরু হয় অনেক আলোচনা ও সমালোচনা। কেউ ভারতকে নিয়ে নিন্দা করছে কেউবা দুষছে নিজেদের উদাসীনতাকে।
অবশেষে ৮ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে এখানেই সবকিছু শেষ নয়, কাজ আরও ঢের বাকী। প্রাথমিকভাবে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি আর জিআই সনদ পাওয়া এক নয়। ভারত টাঙ্গাইল শাড়ির এই জিআই স্বত্বের দাবির বিরুদ্ধে আপিল করবে। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে কি-না তা মূলত জানা যাবে আরও অন্তত দু মাস পর।
জিআই এর পূর্ণ রূপ হলো জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেটর, বাংলায় যার অর্থ ভৌগোলিক নির্দেশক। যে জিআইকে নিয়ে এতটা উত্তেজনা সেই স্বীকৃতির মহিমা বুঝতে হলে জানা প্রয়োজন একটি দেশের জন্যে জিআই স্বত্ব ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সাথে বোঝা দরকার জিআই স্বত্ব পেলে একটি পণ্যের মূল্য ও সেই দেশের মর্যাদা বিশ্ববাজারে কতটুকু প্রভাব ফেলে।
জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক হলো একটি দেশ বা অঞ্চলের কোনো পণ্যকে তাদের পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে কোনো পণ্য বা সংস্কৃতির মূল উৎস সন্ধানের বিষয়ে আগ্রহ উদ্ভূত হয়। তবে প্রথমবার এই বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনা হয় ১৮৮৩ সালের প্যারিস কনভেনশনে।
জিআই স্বত্বের অধিকারী হতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলকে পণ্যের উৎপত্তিস্থল হতে হয়। যদি সেখানকার পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে এবং সেই পণ্য ঐ অঞ্চলের ঐতিহ্যের অংশ হয় তবেই তাকে সে দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সহজ কথায় পণ্যের গুণগত মান, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও জনপ্রিয়তা এবং এর উৎপত্তিস্থলের সাথে বিদ্যমান সম্পর্ক বিবেচনার মাধ্যমে এ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা (ডব্লিউআইপিও) বিভিন্ন শর্তাবলী মেনে নেওয়ার সাপেক্ষে জিআই স্বীকৃতি ও সনদ দেয়। সাধারণত প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষিপণ্য, কুটির শিল্প, কোনো অঞ্চলের বিখ্যাত খাদ্য ও পানীয়কে এ সনদ দিয়ে থাকে। এই সনদ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পণ্যের মেধাস্বত্বের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করে। সেই সাথে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের অধিকার দিয়ে থাকে। এতে সেই পণ্যের আন্তর্জাতিকভাবে কদর বৃদ্ধি পায়। যে দেশের পণ্য সে দেশও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়।
২০১৩ সালে প্রথমবার বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন প্রণীত হয়। ২০১৫ সালে জিআই পণ্যের নিবন্ধনের আবেদনপত্র গ্রহণ করতে আহ্বান জানায় পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। তথ্য-প্রমাণসহ সেসব আবেদনপত্র যাচাইয়ের ভিত্তিতে জিআই সনদ দেওয়া হয়।
আবেদন প্রক্রিয়ার অনেকগুলো ধাপ সফলভাবে অতিক্রম করতে পারলে জার্নাল প্রকাশের মাধ্যমে জিআই স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। আবেদন প্রক্রিয়ায় কোনো ভুলভ্রান্তি থাকলে তা সংশোধন করতে হয়। জার্নাল প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে যদি কেউ এর প্রমাণসহ বিরোধীতা করে তাহলে জিআই স্বীকৃতি বাতিল হয়ে যেতে পারে। এই সময়ের মাঝে কোনো সমস্যা না হলে সেই পণ্য জিআই সনদ লাভ করে।
জিআই পণ্যের স্বতন্ত্র পরিচয় বিশ্ববাজারে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। মৌলিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিভিন্ন আঞ্চলিক পণ্য ক্রেতাদেরকে আকৃষ্ট করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে অধিক মূল্য দিয়ে পণ্য কিনতে আগ্রহী হয়। ফলে এ ধরণের পণ্য আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে তা সকলের হাতে পৌছাতে পারে। জিআই পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের ফলে দেশে পর্যটন ও রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। এতে ব্যবসায়ীরা ও কৃষক লাভবান হন। তাছাড়া জিআই পণ্যকে ঘিরে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগও আসে। যার মাধ্যমে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা অর্জনের পথ তৈরি হয়।
২০১৬ সালে জামদানি শাড়ি বাংলাদেশের প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে সনদপ্রাপ্ত হয়। সেই থেকে বিশ্ববাজারে জামদানি শাড়ির গুরুত্ব উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পায়। বিয়ে থেকে শুরু করে ফ্যাশন শো, কানের (Cannes) লাল গালিচা, বিশ্বসুন্দরীদের প্রতিযোগিতা বলতে গেলে সবখানে দেশি জামদানির জয়জয়কার।
অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত ক্ষীরসাপাতি ও ল্যাংড়া আমের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে। জিআই পণ্য হওয়ার পর ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আম বিপুল পরিমাণে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়াও পদ্মার ইলিশ ও বাগদা চিংড়ি বিভিন্ন দেশে রপ্তানির মাধ্যমে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাগদা চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে ১৯ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। এর পাশাপাশি বর্তমানে মসলিন কাপড় ও শীতলপাটির রপ্তানি ঘিরে নতুন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন মোট ৩১টি পণ্য জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে অনুমোদিত হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনটি নতুন জিআই পণ্যের জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হলো জামালপুরের নকশি কাঁথা, যশোরের খেজুর গুড় ও রাজশাহীর মিষ্টি পান। ২০২৪ সালে জিআই পণ্যের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা ব্যক্ত করেছে ডিপিডিটি।
জিআই পণ্যগুলো বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করছে। দেশের জিআই পণ্যগুলো মূলত কৃষিভিত্তিক ও কুটিরশিল্পকে কেন্দ্র করে। কৃষিকাজ দেশের অর্থনীতিতে সিংহভাগ অবদান রাখছে আবার শৈল্পিক হাতের কাজও মানুষের নজর কাড়ছে। তাই বাংলাদেশের জিআই পণ্যের যথাযথ বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় জিআই পণ্যের সম্ভাবনা নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা বা গবেষণা নেই। এমনকি দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঠিকমতো উদ্যোগ নিচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলার ঐতিহ্যবাহী নানা খাবার বা শিল্প রয়েছে যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সেগুলোকে জিআই স্বীকৃতি এবং সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হলে পণ্যগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি দেশের মানুষ দেশীয় পণ্যের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করবে।
শুধু জিআই স্বীকৃতি পেলেই হবে না, এগুলোর সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন, পদ্মার ইলিশ মাছের স্বাদ অনন্য। কারণ সেখানে বিশেষ ধরনের শৈবাল পাওয়া যায়। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গায় সাকার মাছ বেড়ে গেছে। যা অচিরেই পদ্মায় হানা দিয়ে শৈবাল ধ্বংস করে ফেলতে পারে। তাই জিআই স্বত্ব পাওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একইভাবে সেই সম্পদ রক্ষা করাটাও প্রয়োজন।
m.maliha906@gmail.com