Bangla
2 days ago

কালের বিবর্তনে যেসব কারুশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

Published :

Updated :

সময়ের সাথে মানুষের পছন্দ কিংবা জীবনযাপনে পরিবর্তন আসে। একসময় যে জিনিসটি ছাড়া বাঙালী ঘর অনেকটাই অসম্পূর্ণ থাকতো, কালের বিবর্তনে সেই জিনিস যেন এখন খুঁজে পাওয়াই ভাড়। আর এভাবেই সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাঙালী সংস্কৃতির নানা নিদর্শন।

বঙ্গদেশে কারুশিল্পের যাত্রা সেই প্রাচীনকাল থেকেই। এই শিল্পের খোরাক শুধু বাঙালী রুচিবোধ থেকেই নয়, অনেকটা প্রয়োজনের তাগিদেই হয়েছিল৷ তবে, গ্রামীণ শিল্পীরা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসকে শিল্পের ছোঁয়ায় রাঙিয়ে যে নান্দনিকতার ছাপ রেখেছে সেজন্য বাঙালীর শিল্পী সত্তাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।

একসময় বাঙালী পরিবারে পাওয়া যেত বাঁশ, বেত কিংবা তালপাতার তৈরি হরেক রকম তৈজসপত্র। এছাড়া বেতের তৈরি সোফা কিংবা অন্যান্য আসবাবপত্রও মানুষের নজর কাড়তো। সেগুলো একদিকে যেমন টেকসই, অন্যদিকে ছিল দৃষ্টিনন্দন।

তবে সেসব সোনালী দিন এখন আর নেই। তার বদলে ঠাঁই করে নিয়েছে প্লাস্টিক কিংবা বিভিন্ন ধাতব পদার্থ হতে তৈরি জিনিসপত্র। অথচ প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন জিনিস একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করে, ঠিক তেমনি পরিবেশেরও বিপর্যয় ডেকে আনে।

অন্যদিকে যান্ত্রিক উপায়ে তৈরি এসব জিনিসে ডিজাইন কিংবা রঙের বাহার থাকলেও শিল্পীর দক্ষ হাতের নিপুণ ছোঁয়া বরাবরই অধরা থেকে যায়। কালের বিবর্তনে হারাতে বসা সেসব জিনিস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব এই লেখায়।

হাতপাখা

হাতপাখা আবহমান বাংলা সংস্কৃতির এক চিরায়ত রূপ। ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে এটি শুধু গৃহেই নয়, জায়গা করে নিয়েছে সাহিত্য কিংবা ইউনেস্কো স্বীকৃত অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মঙ্গল শোভাযাত্রাতেও। প্রয়োজনের তাগিদে এর যাত্রা শুরু হলেও নান্দনিক ডিজাইন আর বাহারি রঙের হাতছানিতে এটি স্থান করে নিয়েছে বাঙালীর সাংস্কৃতিক জাতিসত্তায়।

মূলত তালপাতা দিয়ে তৈরি করা হয় এসব হাতপাখা। শিল্পীর নিপুণ দক্ষতায় তালপাতা কেটে বানানো হয় এক একটি পাখা।

তবে পাতা থেকে হাতপাখায় রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি সহজ নয়। এজন্য সময় এবং শ্রম- দুটোই ব্যয় করতে হয়। পাশাপাশি হরেক রকম রঙের ব্যবহার করে কুটিরশিল্পীরা তাদের শিল্পী সত্তার জানান দেন এই কাজে।

তবে দুঃখের বিষয় হলো গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব হাতপাখা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। একসময় হাট-বাজারে নিয়মিত হাতপাখা দেখা গেলেও এখন তা চোখে পড়াই ভাড়। এর জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে ইলেকট্রনিক পাখা।

তবে মনে রাখতে হবে বিজ্ঞানের কল্যাণে জীবনে গতি আসবে ঠিকই, কিন্তু এর সাথে সাথে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিগুলোকেও টিকিয়ে রাখতে হবে। কারন সংস্কৃতিই একটি জাতির ধারক ও বাহক।

বাঁশি

বাঁশের বাঁশি একসময় ছিল মানুষের বিনোদনের একটি মাধ্যম। সাহিত্যে রাখালের বাঁশির মোহনীয় সুরের কথা বর্ণিত আছে বহু জায়গায়। এছাড়া গ্রামের হাটেও এর অবস্থান ছিল বেশ দাপুটের সঙ্গে। তবে কালের বিবর্তনে বাঁশির সেই সুদিন আজ আর নেই। গ্রামেও এখন আর কেউ উদাস দুপুরে বাঁশি বাজায় না। এছাড়া সঙ্গীতেও এই বাদ্যযন্ত্রটির ব্যবহার বর্তমানে খুবই সীমিত। আর তাই তো আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার আরো একটি নিদর্শন।

শীতলপাটি

বর্তমানে দেশের শহরাঞ্চল থেকে শুরু করে গ্রামঞ্চল পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। তবে একটি সময় ছিল যখন বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলেই বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছায়নি। বৈদ্যুতিক পাখা না থাকাতে ভরদুপুর কিংবা রাতের বেলা পরিবার অথবা প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডা জমে উঠতো শীতলপাটির কল্যাণে। পরিবার-পরিজন কিংবা প্রতিবেশীরা একসাথে শীতলপাটিতে বসে গল্পে মেতে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এই শীতলপাটি তৈরি হয় পাটিপাতা নামক একটি গাছ থেকে যেখানে বুননশিল্পীরা হরেক রকম আলপনায় রাঙিয়ে তুলত শীতলপাটির উপরিভাগ।

এই শীতলপাটি বর্তমানে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়া শীতলপাটির বুননশিল্প স্থান করে নিয়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে।

তবে দুঃখের বিষয় হলো বিশ্ব দরবারে স্বীকৃত এই পণ্যটি তার নিজ দেশেই অনেকটা উপেক্ষিত হয়ে আছে। বিশেষ করে শহরে শীতলপাটির ব্যবহার বর্তমানে অত্যন্ত সীমিত। আর এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে শীতলপাটির স্বর্ণালী অতীত।

বেতের আসবাবপত্র

একসময় বেত দিয়ে তৈরি সোফা কিংবা অন্যান্য আসবাবপত্রের কদর ছিল তুঙ্গে। সেগুলো একদিকে যেমন টেকসই, অন্যদিকে দৃষ্টিনন্দন ডিজাইনের কারণে সহজেই মন ছুঁয়ে যেত।

বেত গাছ নামক এক ধরনের লতানো উদ্ভিদের কান্ড থেকে তৈরি হতো এসব আসবাবপত্র। তবে সময়ের সাথে সাথে বেতের ব্যবহারও দিন দিন কমে যাচ্ছে। বেতের বদলে সেখানে স্থান করে নিচ্ছে কাঠের তৈরি বিভিন্ন আসবাবপত্র। এছাড়া প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন জিনিসও বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে বেতের বিকল্প হিসেবে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিকের ব্যবহার শরীরের উপর দীর্ঘমেয়াদে জটিল প্রভাব ফেলে। এছাড়া পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রেও প্লাস্টিক বহুলাংশে দায়ী। অথচ এতকিছুর পরেও মানুষ ছুটছে প্লাস্টিকের পেছনে যেখানে এটির একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প তাদের হাতের নাগালেই আছে।

ডালা

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে ডালা একটি পরিচিত নাম। বিশেষ করে নবান্নে এর কদর বেড়ে যায় বহুগুণ। পাশাপাশি গ্রামীণ সংস্কৃতিতে ফসল তোলা কিংবা সেগুলোর সংরক্ষণের কাজেও ডালা ব্যবহৃত হয়।

তবে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই পণ্যটিতেও থাবা বসিয়েছে প্লাস্টিকের তৈরি তৈজসপত্র। দামে তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় অনেকেই প্লাস্টিকের তৈরি এসব জিনিসের দিকে ঝুঁকছে। ফলশ্রুতিতে আমরা হারাতে বসেছি আমাদের আরো একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে।

অতীত সর্বকালেই একটি জীবন্ত উপাখ্যান হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রতিটি বাঁকই যেন এক একটি ইতিহাস। কিন্তু বিশ্বব্যাপী আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক ঐতিহ্যই আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

tanjimhasan001@gmail.com

Share this news