Bangla
7 days ago

কেমন ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম-বাংলার মানুষের জীবন?

Published :

Updated :

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এই যুদ্ধকে আমরা প্রায়ই শহরের রাজপথ, সেনানিবাস বা সীমান্তের যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেখি। অথচ প্রকৃত অর্থে এই যুদ্ধের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, সবচেয়ে রক্তাক্ত এবং সবচেয়ে নিঃশব্দ সংগ্রাম চলেছিল গ্রামবাংলায়। নদী, খাল, বিল, ধানক্ষেত আর কাঁচা রাস্তার মাঝেই গ্রামবাংলার মানুষ বয়ে নিয়েছিল যুদ্ধের ভার—নিঃশব্দে, নিরবচ্ছিন্নভাবে। গ্রামবাংলার জীবন তখন হয়ে উঠেছিল ভয়, ক্ষুধা, প্রতিরোধ ও অদম্য সাহসের এক জটিল সমন্বয়।

যুদ্ধের আগে গ্রামবাংলার শান্ত জীবন

একাত্তরের আগে গ্রামবাংলার জীবন ছিল সরল ও ছন্দময়। কৃষিকাজই ছিল মানুষের মূল অবলম্বন। বছরের ঋতুচক্র অনুযায়ী জীবন চলতো—বোনা, রোপণ, কাটা, ঘরে তোলা। সকাল শুরু হতো মাঠের কাজে, সন্ধ্যা নামত গল্প আর বিশ্রামে। গ্রামীণ সমাজ ছিল আত্মীয়তা ও প্রতিবেশিতার বন্ধনে গড়া।

মানুষ রাজনৈতিকভাবে খুব শিক্ষিত না হলেও অন্যায়ের ধারণা ছিল স্পষ্ট। ভাষা আন্দোলনের গল্প শোনা হতো বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে। ছয় দফা আর ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের কথা গ্রামে গ্রামে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় গ্রামবাংলায় নতুন আশা তৈরি করেছিল—মানুষ বিশ্বাস করেছিল, এবার হয়তো শোষণের অবসান হবে। কিন্তু এই আশাই পরিণত হয়েছিল ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে।

হঠাৎ বদলে যাওয়া জীবন

২৫ মার্চের গণহত্যার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও অভিযান শুরু করে। নদীপথে গানবোট, স্থলপথে সেনা ট্রাক—গ্রাম আর নিরাপদ আশ্রয় ছিল না। অনেক গ্রামে সেনারা ঢুকতো হঠাৎ, কোনও পূর্বসংকেত ছাড়াই।

সেনারা পুরুষদের আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করতো, তরুণদের ধরে নিয়ে যেত, সন্দেহ হলেই গুলি চালাত। কোথাও পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হতো, যেন ভয় ছড়িয়ে দেয়া যায় আশপাশের এলাকাতেও। রাত ছিল সবচেয়ে আতঙ্কের সময়। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মানুষ শুনতো দূরের গুলির শব্দ, আগুনের লেলিহান শিখা। গ্রামে তখন আলো জ্বালানো, জোরে কথা বলা, এমনকি শিশুর কান্নাও হয়ে উঠেছিল বিপজ্জনক।

সংখ্যালঘু নির্যাতন ও পরিকল্পিত ধ্বংস

গ্রামবাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের বড় শিকার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের গ্রামগুলোকে পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করা হতো। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, সম্পদ লুট, পুরুষদের হত্যা এবং নারীদের নির্যাতন, এসব ছিল এক ভয়াবহ বাস্তবতা।

তবে শুধু সংখ্যালঘুরাই নয় যেসব মুসলিম পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতো, স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিত, তারাও ছিল ঝুঁকির মধ্যে। ফলে গ্রামে গ্রামে তৈরি হয় সার্বিক অনিরাপত্তা। কেউ জানত না, পরের নিশানাটা কার ওপর পড়বে। এই ভয় গ্রামবাংলার সামাজিক কাঠামোকেও ভেঙে দিতে শুরু করে।

ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ

যুদ্ধের সবচেয়ে নীরব অথচ নির্মম দিক ছিল খাদ্যসংকট। কৃষিকাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অনেক জমি পড়ে থাকে অনাবাদি। কোথাও ফসল পুড়ে যায়, কোথাও সেনারা লুট করে নিয়ে যায়।

চালের দাম বেড়ে যায়, বাজার বসে অনিয়মিত। বহু পরিবার দিনে এক বেলা বা তারও কম খেয়ে দিন কাটায়। শাকপাতা, কচু, লতাপাতা, কখনো শুধু পানিতে ভেজানো ভাত—এই ছিল বহু গ্রামের বাস্তবতা। সবচেয়ে কষ্টে ছিল শিশু ও বৃদ্ধরা।

তবু এই ক্ষুধা মানুষকে হার মানাতে পারেনি। মানুষ মুক্তির জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল, জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। 

নারীদের নীরব প্রতিরোধ

একাত্তরের গ্রামবাংলায় নারীরা ছিলেন সবচেয়ে নীরব অথচ সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা। তারা সংসার টিকিয়ে রেখেছেন, সন্তান বাঁচিয়েছেন, আবার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সহায়তা দিয়েছেন। রাতের অন্ধকারে রান্না করে খাবার পৌঁছে দেওয়া, আহতদের সেবা করা—এসব ছিল তাদের দৈনন্দিন দায়িত্ব।

একই সঙ্গে বহু নারী পাকিস্তানি বাহিনীর যৌন সহিংসতার শিকার হন। তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষত আজও ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়। যুদ্ধ শেষে ‘বীরাঙ্গনা’ স্বীকৃতি পেলেও সামাজিক বাস্তবতা তাদের জন্য সহজ ছিল না। তবু এই নারীরাই গড়েছিলেন গ্রামবাংলার প্রতিরোধের শক্ত ভিত।

গ্রামবাংলা: মুক্তিযুদ্ধের শক্তিশালী ঘাঁটি

গ্রামবাংলাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ঘাঁটি। শহরের বাইরে গ্রামেই চলেছে গেরিলা যুদ্ধের মূল প্রস্তুতি। বাঁশঝাড়, খাল, চর, ধানক্ষেত—সবকিছু ব্যবহার হয়েছে কৌশলগতভাবে।

গ্রামের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখত, পথ দেখাত, শত্রুর খবর দিত। অনেক স্কুল, মাদ্রাসা, পরিত্যক্ত বাড়ি হয়ে উঠেছিল অস্থায়ী ক্যাম্প। গ্রামীণ তরুণরা দলে দলে যুদ্ধে যোগ দেয়—কেউ শহীদ হয়েছে, কেউ বিজয় নিয়ে ফিরেছে।

রাজাকারদের কারণে ঘটা ভাঙন ও বিশ্বাসঘাতকতা

সব গ্রাম একমত ছিল না। কিছু মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়ে ওঠে। রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ছিল গ্রামেরই পরিচিত মুখ। তারা সেনাদের তথ্য দিত, নিরীহ মানুষকে ধরিয়ে দিত।

এর ফলে গ্রামবাংলায় তৈরি হয় গভীর বিভাজন। ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে প্রতিবেশী। এই বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষত অনেক গ্রামে আজও ইতিহাসের কালো দাগ হয়ে আছে।

শরণার্থী জীবন

পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে লাখ লাখ গ্রামবাসী ভারতে আশ্রয় নেয়। নদী পার হয়ে, হেঁটে, গরুর গাড়িতে করে তারা সীমান্তে পৌঁছায়। শরণার্থী শিবিরে জীবন ছিল কষ্টকর—খাবার অল্প, রোগব্যাধি বেশি, তবু সেখানে ছিল প্রাণের নিরাপত্তা। এই শরণার্থী শিবির থেকেই অনেক তরুণ প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।

বিজয়ের পর: ধ্বংসের ভেতর নতুন শুরু

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের খবর গ্রামে পৌঁছায় রেডিও আর মুখে মুখে। কোথাও আনন্দের উল্লাস, কোথাও নীরব কান্না। অনেক মানুষ ফিরে এসে দেখে তাদের বাড়ি নেই, পরিবার নেই, শুধু পোড়া ভিটা আর স্মৃতি। তবু গ্রামবাংলা আবার দাঁড়ায়। নতুন করে ঘর তোলে, মাঠে ফসল ফলায়। কিন্তু যুদ্ধের স্মৃতি থেকে যায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তবে, তাদের ত্যাগ, সহনশীলতা ও সাহস ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশ কল্পনাই করা যেত না।

mahmudnewaz939@gmail.com

Share this news