Bangla
10 months ago

কেন প্রকৃতিতে নীল রং বিরল?

Representational image
Representational image

Published :

Updated :

আকাশ, সাগর মহাসাগর নীল। অথচ কাওকে নীল রংয়ের ফুলের নাম যদি বলতে বলা হয়, তবে অপরাজিতা বা নীলকন্ঠ ফুল আর নীলমণি ছাড়া ফুলের কথা হয়তো মনে পড়বে না। কিংবা নীল রংয়ের প্রাণীর কথাই যদি বলি? ময়ূর? তাহলে নীল রং প্রকৃতিতে কি অত্যন্ত বিরল? আসলে ব্যাপারটা তাই৷ এই রঙের পেছনে রয়েছে গভীর বৈজ্ঞানিক কারণ এবং অনন্য প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা একে অন্যান্য রঙের তুলনায় আলাদা করে তোলে।

পুরো বিষয়টি বুঝতে হলে জানতে হবে আমরা কেন রং দেখতে পাই এবং বুঝতে হবে কীভাবে রং কাজ করে। রং আসলে আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য এর উপস্থিতি যা আমাদের চোখ উপলব্ধি করে। যখন আলো কোনো বস্তুতে আঘাত করে, তখন সেই বস্তু কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে এবং বাকি তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে এবং মস্তিষ্ক সেই তথ্যকে নির্দিষ্ট রঙ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সবুজ পাতা সবুজ তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে, তাই আমরা তাকে সবুজ দেখি।

নীল রং এবং রাসায়নিক গঠন

প্রকৃতিতে অধিকাংশ রং রাসায়নিক রঞ্জক দ্বারা তৈরি হয়। রঞ্জক হলো এক বিশেষ জৈব যৌগের অণু যা আলোর নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে এবং প্রতিফলিত করে। কিন্তু নীল রং তৈরির জন্য উপযুক্ত রাসায়নিক রঞ্জক খুবই বিরল। অধিকাংশ প্রাকৃতিক রঞ্জক যেমন কারোটিন (কমলা), অ্যান্থোসায়ানিন (লাল, বেগুনি), এবং ক্লোরোফিল (সবুজ) সহজলভ্য। 

কিন্তু নীল রঞ্জক তৈরির জন্য উপযুক্ত যৌগিক পদার্থ প্রকৃতিতে খুব কম পাওয়া যায়। ইন্ডিগো হলো একটি প্রাকৃতিক রঞ্জক যা ইন্ডিগোফেরা গণের কিছু গাছের পাতা থেকে নিষ্কাশিত হয়, বিশেষ করে ইন্ডিগোফেরা টিনক্টোরিয়া । আরেকটি হচ্ছে অ্যান্থোসায়ানিন গোত্রের রঞ্জক যেখানে নাল থেকে নীল রং প্রস্ফুটিত হয়। 

প্রকৃতির বিভিন্ন প্রাণী এবং উদ্ভিদ তাদের নিজস্ব উপায়ে নীল রং ধারণ করেছে, যা বৈজ্ঞানিকভাবে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। 

উদ্ভিদে নীল রং

গাছপালায় নীল রং খুব কম দেখা যায়। কিছু নীল ফুল যেমন ব্লু মর্নিং গ্লোরি এবং ব্লু অর্কিড একান্তই বিরল। এই উদ্ভিদগুলো বিশেষ রাসায়নিক যৌগের মাধ্যমে তাদের নীল রং তৈরি করে, যা সাধারণত অ্যান্থোসায়ানিন নামে পরিচিত। এই যৌগিক পদার্থগুলো অত্যন্ত কম এবং তাদের প্রক্রিয়াও জটিল।

প্রাণিজগতে নীলের অস্তিত্ব 

তবে নীল রং প্রাণিজগতে বেশিরভাগ সময় বায়োফিজিক্সের মাধ্যমে তৈরি হয়, রাসায়নিক রঞ্জক দিয়ে নয়।  এই প্রক্রিয়ায়  আলোকে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে প্রতিফলিত করে নীল রঙের প্রভাব সৃষ্টি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রজাপতির পাখা বা পাখির পালকের কাঠামো এমনভাবে সাজানো থাকে যে তারা শুধুমাত্র নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে। ‘স্ট্রাকচারাল সিলেকশন’ বা কাঠামবদ্ধ নির্বাচন।  

কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ময়ূরের পেখম, নীলকন্ঠ পাখির ঘাড়, নীল জয় পাখি, এবং ব্লু মরফো প্রজাপতি—এদের নীল রঙ এভাবে তৈরি হয়। সমুদ্র এবং আকাশের নীল রংও এই কাঠামবদ্ধ নির্বাচনের উদাহরণ, যেখানে জল বা বায়ু কণাগুলি আলোকে এমনভাবে প্রতিফলিত করে যেন তা আমাদের চোখে নীল দেখা যায়।

প্রকৃতির সতর্কবার্তা নীল

নীল রঞ্জক প্রায়শই অস্বাভাবিক এবং কিছু ক্ষেত্রে নীল রঞ্জক প্রাণীদের মধ্যে বিষাক্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু ব্যাঙের নীল ত্বক বিষাক্ত রাসায়নিক ধারণ করে, যা তাদের শত্রুদের থেকে রক্ষা করে।  ডেনড্রোবেটিড ব্যাঙের নীল ত্বক বিষাক্ত রস উৎপাদন করে যা শিকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে। এই বিষাক্ততার কারণে, অনেক প্রাণী নীল রং ব্যবহার করে সতর্ক সংকেত দেয়। নীল রংয়ের সাপ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। 

সভ্যতায় নীল রং

নীল রঙের এই বিরলতা মানব সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলেছে। প্রাচীন কালে, নীল রঙের রঞ্জক তৈরি করা ছিল অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। মিশরের ফিরোজা পাথর এবং মধ্যযুগের ল্যাপিস লাজুলি থেকে তৈরি নীল রং ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তাই নীল রঙের কাপড় এবং শিল্পকর্ম উচ্চ মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। আর ব্রিটিশ আমলের নীল চাষ থেকে নীল বিদ্রোহ এর কথা তো সবার জানা। 

nidrisanan7314@gmail.com

Share this news