তারল্য সংকট তীব্রতর
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের ওপর ব্যাংকগুলোর নির্ভরশীলতা রেকর্ড উচ্চতায়
Published :
Updated :
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ক্রমেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো সুবিধা ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো রেকর্ড ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এতে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিদ্যমান তারল্য সংকটের আরও অবনতি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ধীরগতির আমানত প্রবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান নন পারফর্মিং লোন (এনপিএল) এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংকিং খাতে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর এই বাড়তি নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, এই অতিনির্ভরশীলতা ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতার প্রতিফলন। অনেক ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি রেপো ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করছে, যাতে উচ্চ রিটার্ন নিশ্চিত করা যায়। ফলে সরকারি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হারও কমছে।
ব্যাংকারদের ভাষ্যে, আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া এবং খেলাপি ঋণের উচ্চ হার ব্যাংকগুলোকে স্থানীয় মুদ্রায় বাধ্যবাধকতা পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো উইন্ডোর ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে ব্যাংকগুলো রেপো সুবিধার আওতায় মোট ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ১৪ দিনের মেয়াদী রেপো সুবিধা থেকেই এসেছে প্রায় ৮৪ শতাংশ অর্থ, বাকি টাকা ৭ দিনের এবং ওভারনাইট রেপো থেকে।
এর আগে এপ্রিল ও মার্চ মাসে রেপো ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৯৪ হাজার কোটি ও ৮৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ১৪ দিনের রেপো ঋণের ওপরই মূলত ব্যাংকগুলো ভরসা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারদের অভিযোগ — অনেক ব্যাংক এই স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে তা দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করছে, যা অর্থনীতির স্থবির পরিবেশে বেশি লাভজনক হলেও সার্বিক তারল্য সংকটকে আরও গভীর করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, রেপো ঋণের এই বাড়তি ব্যবহার প্রমাণ করে যে, দেশের অধিকাংশ ব্যাংক বর্তমানে গভীর তারল্য সংকটে রয়েছে।
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা অনেক কমে গেছে। জুলাই-আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থানের পর সরকারের পতন এবং ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির একের পর এক ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় আমানতকারীদের আস্থা অনেকটাই নষ্ট হয়েছে।
এর পাশাপাশি, মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় — যা ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত মোট ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এমন পরিস্থিতিতে আমানত বৃদ্ধি আটকে থাকায় ব্যাংকগুলোর আর বিকল্প উপায় থাকছে না। বাধ্য হয়েই তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেপো সুবিধার ওপর বেশি নির্ভর করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ২১ শতাংশ, যেখানে তিন বছর আগেও এ হার ছিল ১২ শতাংশের ওপরে।
এক বাণিজ্যিক ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেপো সুবিধা ব্যবহার করে তাদের নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) এর ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ব্যাংক এ স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বন্ড কিনে রাখছে বেশি মুনাফার আশায়।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে তাদের মোট আমানতের ৪ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সিআরআর হিসেবে জমা রাখতে হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ মে মাসে ব্যাংকগুলো ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা পরিস্থিতির প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট করে। “বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কয়েক সপ্তাহের জন্য রেপো সুবিধা বন্ধ করে দেয়, তাহলে অধিকাংশ ব্যাংক ভেঙে পড়বে,” মন্তব্য করেন তিনি।
এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো সুবিধার পরিধি সীমিত করছে। ইতোমধ্যে দৈনিক রেপো সুবিধা সপ্তাহে একদিনে নামিয়ে আনা হয়েছে এবং ২৮ দিনের রেপো সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। আগামী মাস থেকে ১৪ দিনের রেপো সুবিধাও বন্ধের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
jubairfe1980@gmail.com