Published :
Updated :
ষাটের দশকের শেষ দিকের কথা। তখন 'ত্রিরত্ন' নামে একটি কমেডি নাটক খুবই জনপ্রিয় হয়৷ হীরা, চুনি, পান্না নামে তিনটি চরিত্র ছিলো এখানে৷ এর ভেতর চুনি-র চরিত্রটি করতেন অভিনেতা খান জয়নুল। তার আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গি, ভ্রু নাচানো, ছোটখাটো গড়ন আর সংলাপ প্রক্ষেপণের অসামান্য ক্ষমতা তাকে করে তোলে তুমুল জনপ্রিয়।
১৯৫৩ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়স তা অভিনয়জীবনের শুরু। তখন মঞ্চে নাটক করতেন। সে সময়ই অভিনয়কে ভালোবেসে ফেলে তিনি কিছুদিন পর পাড়ি জমান কোলকাতায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তখনও সিনেমা শিল্পের শুরু হয়নি। কোলকাতায় 'মৃণাল কান্তি রায়' ছদ্মনামে কিছু চলচ্চিত্রে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করলেও পরে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর চাকরি নেন সাপ্তাহিক 'পুবালী' পত্রিকায়।
তার সাংবাদিক জীবন চলতে থাকে।এর ভেতরই ১৯৬৪ সালে হয়ে যায় চলচ্চিত্রে অভিষেক। সুভাষ দত্তের 'সুতরাং' ছবিটিতে অভিনয় করেন তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অভিনয় করে গেছেন একের পর এক সিনেমায়।
এর বাইরে তার লেখার হাতও ছিলো খুব ভালো। বশীর হোসেনের '১৩ নং ফেকু অস্তাগার লেন' (১৯৬৬) সিনেমার চিত্রনাট্য লেখেন তিনি। অভিনয়ও করেছিলেন এই সিনেমায়। তার অনবদ্য কৌতুক অভিনয় সিনেমাটিকে সমৃদ্ধ করে। এর বাইরে 'দুই দিগন্ত', 'সাইফুল মুলক বদিউজ্জামাল', 'কাঁচ কাটা হীরে' (জহির রায়হান), 'পদ্মা নদীর মাঝি', 'ঝড়ের পাখি' (সি বি জামান), 'দর্পচূর্ণ ' (নারায়ণ ঘোষ মিতা), 'মধুমালা', 'ময়নামতি' (কাজী জহির), 'যে আগুনে পুড়ি', 'নীল আকাশের নীচে' (মিতা), 'মায়ার সংসার' ও দিওয়ানা (সর্বশেষ চলচ্চিত্র)-সহ বিভিন্ন সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন।
বেশিরভাগ সিনেমাতেই তিনি কৌতুকাভিনয় করতেন। কিন্তু তার অভিনয়ে কোনো ভাঁড়ামো ছিলো না, ছিলো না জোর করে হাসানোর কোনো চেষ্টা৷ চরিত্র অনুযায়ী সাবলীলভাবে সংলাপ ডেলিভারি করতেন তিনি। এর সঙ্গে নন-ভার্বাল বা অবাচনিক প্রকাশভঙ্গি-র সাহায্যে জীবন্ত করে তুলতেন চরিত্রটিকে।
১৯৭৪ সালে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় এলে খান জয়নুলের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শিল্পীরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভানু তার অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।
নাট্যকার হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার লেখা হাস্যরসাত্মক নাটক 'শান্তিনিকেতন' মঞ্চে পরিবেশিত হয়ে যথেষ্ট প্রশংসা পায়।
তবে এতসব সাফল্যের পরেও প্রদীপের নিচে থাকা আঁধারের মতো, তার জীবনেও ছিলো একটি গোপন কষ্ট। বিয়ের দিন বাসরে স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে তিনি জানতে পারেন তার স্ত্রীর অন্য ভালোবাসার মানুষ আছে। তিনি সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে স্ত্রীকে তার প্রেমিকের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। এভাবে তার জীবনটাই যেন পরিণত হয়েছিল এক সিনেমায়। এই ঘটনা তাকে ভেতর থেকে ভেঙেচুরে দেয়।
অনেক পরে তিনি আবার বিয়ে করেন, সন্তানও হয়৷ কিন্তু ওই হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে তিনি পানাসক্ত হয়ে পড়েন। এই অভ্যাসটি আর দূর করতে পারেননি। দিনে দিনে এটি আরও বাড়ে। মদে আসক্ত হবার ফলে শুটিংয়ে যেতে পারতেন না। পরিচালকরা অপেক্ষা করতেন। তার ইস্কাটনের বাড়িতে এসে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।
কিন্তু সেই মানুষটিই ক্যামেরার সামনে গেলে হয়ে যেতেন অন্যরকম। একদম নিখুঁত অভিনয় করে যেতেন, দর্শককে হাসিয়ে মারতেন তার সুনিপুণ অভিনয়ে। তার আরেকটি বিশেষ দক্ষতা ছিলো ইম্প্রোভাইজেশন।
ক্যামেরার সামনে সংলাপ বলতেন একভাবে, ডাবিংয়ে আবার গলায় কিছু পরিবর্তন আনতেন। সেটা এতটাই নিখুঁত হতো যে, দর্শক কোনো পার্থক্য করতে পারত না।
সিনেমা ও লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করলেও প্রথম বিয়ের দিনের সেই ট্রমা খান জয়নুল কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার লিভারের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে পড়ছিল। অবশেষে ৪০ বছর পূরণ হবার আগেই ১৯৭৬ সালের ১৫ জানুয়ারি- এক তীব্র শীতের দিনে তিনি মারা গেলেন।
সময় পেরিয়ে গেছে এরপর। প্রায় ৫০ বছর পরে এসে মানুষ ভুলে গেছে এই অসামান্য অভিনেতাকে। তাকে নিয়ে হয়না কোনো স্মরণসভা কিংবা আলোচনা অনুষ্ঠান। অথচ খান জয়নুলকে বাদ দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। ১৯৩৬ সালের ৪ জুলাই বিক্রমপুরের (মুন্সীগঞ্জ) লৌহজং উপজেলার রানাদিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। ৮৯ তম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।
mahmudnewaz939@gmail.com