Bangla
a year ago

'খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে'- এই বর্গী আসলে কারা?

Representational image
Representational image

Published :

Updated :

'খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে'- ছোটবেলায় এ ছড়াটি শুনেনি এমন মানুষ খুব কমই আছে। আমাদের প্রত্যেকের ছোটবেলার সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এ ছড়াটি। তবে একবার ভাবুন তো ছড়ায় থাকা বর্গী শব্দটি আসলে কাদের বোঝায়? আর কেনই বা তারা এসেছিল এ দেশে?

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সম্পদ ও ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। আর তাই তো বিদেশী শাসকদের চোখ বরাবরই ছিল আমাদের এই সবুজ-শ্যামল মাতৃভূমির প্রতি। নিজেদের প্রয়োজনে কখনো তারা এ দেশ শাসন করেছে, কখনো বা চালিয়েছে লুট। আর বর্গী তেমনই এক ভিনদেশী দস্যুদল যারা একসময় লুটপাট চালায় বঙ্গভূমিতে।

বর্গীদের ইতিহাস বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় তিনশত বছর আগে। সময়টা তখন ১৭৪০ সাল। সে বছরের এপ্রিল মাসে আলীবর্দী খান সরফরাজ খানকে পরাজিত করে বাংলার নবাব হন। কিন্তু ভগ্নিপতির এমন পরাজয় এবং মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি তার শ্যালক রুস্তম জং যিনি ছিলেন উড়িষ্যার উপশাসক। তাই তিনি আলীবর্দী খানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন এবং এরই জেরে তিনি নবাবের চক্ষুশূলে পরিণত হন।

একসময় নবাব এক যুদ্ধের মাধ্যমে রুস্তম জংকে পরাজিত করেন এবং নবাব তার ভাইপোকে উড়িষ্যার উপশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন।

এতে করে রুস্তম জং নবাবের প্রতি আরো বেশি ক্ষিপ্ত হন এবং তিনি নানা কূটকৌশল অবলম্বন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি নাগপুরের মারাঠা শাসক প্রথম রঘোজি ভোঁসলের সাহায্য চান। উল্লেখ্য মারাঠারাই মূলত বর্গী নামে পরিচিত ছিল।

মারাঠাদের সহায়তায় রুস্তম জং পুনরায় উড়িষ্যার অধিকার ফিরে পান। তবে পরবর্তীতে নবাব উড়িষ্যায় এসে রুস্তম জংকে পুনরায় পরাজিত করলেও তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে যাওয়ার আগেই মারাঠা সর্দার ভাস্কর পন্ডিত আরেক মারাঠা সদস্যকে অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান করে বাংলায় পাঠান। এসময় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে তারা ব্যাপক লুট চালায়।

১৭৪১ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বাংলায় নিয়মিতভাবে বর্গী হামলা চলতে থাকে। বর্গি বা মারাঠাদের বাস ছিল ভারতের মহারাষ্ট্রে। তবে এর পাশাপাশি তারা ভারতের গোয়া, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, এবং কর্ণাটক অঞ্চলেও বাস করতেন। ধর্মীয় দিক থেকে মারাঠারা ক্ষত্রিয় যোদ্ধা ছিলেন।

মারাঠা সৈন্যরা কোনো অভিযানে যাওয়ার সময় একটি সাত হাত দীর্ঘ কম্বল এবং একটি বর্শা নিয়ে বের হতো। মারাঠি ভাষায় এ বর্শাকে বরচি নামে ডাকা হতো যা একসময় অপভ্রংশের মাধ্যমে বর্গি শব্দে রূপান্তরিত হয় এবং আমরা মারাঠাদের বর্গি নামে সম্বোধন করতে থাকি।

বাংলায় বর্গীদের আক্রমণ বাংলাদেশের যশোর জেলা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। বর্গীদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে এ অঞ্চলে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। তারা জমির ফসল লুট করে নিয়ে যেত এবং নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দিত। বাংলা এবং ভারতবর্ষের অনেক জায়গাই বর্গীদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

বর্গীরা কেন এ অঞ্চলে আক্রমণ করেছিল সেটি নিয়েও আছে ইতিহাস। মূলত মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি বিদ্বেষ থেকেই বর্গীদের থাবা এ অঞ্চলের উপর পড়ে।

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে দক্ষিণ ভারতে একটি সামরিক অভিযান সংগঠিত হয় এবং এতে করে মারাঠা সাম্রাজ্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। তবে মারাঠারা যেহেতু ধর্মীয় দিক থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং তারা মূলত ক্ষত্রীয় যোদ্ধা হিসেবে পরিগণিত হতেন তাই সম্রাট আওরঙ্গজেব মারাঠাদের ক্রোধ নিরসনের জন্য তাদের বেশ কয়েকজনকে মুঘল সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেন।

তবে এতে করেও মারাঠাদের সন্তুষ্ট করা যায়নি। কিছু মারাঠা সদস্য মুঘলদের আনুগত্য মেনে নিলেও বেশিরভাগ মারাঠাই সেসময় পূর্ববর্তী ক্রোধের বশবর্তী হয়ে মুঘলদের সাম্রাজ্যগুলোতে আক্রমণ করতে শুরু করে। বাংলা যেহেতু মুঘল শাসিত প্রদেশ ছিল তাই বাংলা অঞ্চলেও মারাঠারা আক্রমণ করেছিল।

তবে বাংলাকে মারাঠাদের হাত থেকে মুক্ত করতে আলীবর্দী খান প্রথম থেকেই বেশ সোচ্চার ছিলেন। ১৭৫১ সালে নবাব মারাঠাদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেন। সেই চুক্তির ফলে নবাব আলীবর্দী খান উড়িষ্যার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেন এবং সেখানে মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার বিনিময়ে মারাঠারা আলীবর্দী খানের নিয়ন্ত্রিত অন্য সব এলাকায় আক্রমণ বন্ধ করে। এভাবেই শেষ হয় বাংলায় বর্গী নামক এক নৃশংস অধ্যায়ের সমাপ্তি।

tanjimhasan001@gmail.com

Share this news