Published :
Updated :
ঢাকার খাবারের কথা উঠলে অবধারিতভাবেই যে খাবারটির নাম চলে আসে, তা কাচ্চি। কাঁচা থেকেই কাচ্চি। লাল কাপড়ে মোড়ানো বড় হাঁড়িতে চাল ও মাংস একযোগে রান্না হতে থাকে। মাংসের রস মিশে যায় চালের সুবাসের সঙ্গে। তৈরি হয় কাচ্চি।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার কাচ্চি ছিলো মূলত মোগলদের খাবার। বিয়ে বাড়িতে বা বিশেষ আয়োজনে রান্না করা হতো এ খাবার।
ঢাকায় কাচ্চির একটি আপাত সুলভ সংস্করণ তৈরি করে ঠাঁটারিবাজারের স্টার হোটেল অ্যান্ড কাবাব। এরপর এর দেখাদেখি আরো কিছু হোটেল কাচ্চি তৈরিতে নিয়মিত হয়৷ পুরান ঢাকার ফখরুদ্দিন বাবুর্চি কিংবা হাজী সিরাজুল ইসলাম নান্না মিয়ার হাতযশ কাচ্চিকে সাধারণ মানুষের কাছে অনন্য জনপ্রিয়তার স্থানে নিয়ে যায়।
তবে এই কাচ্চিগুলোয় ব্যবহৃত হতো চিনিগুঁড়া চাল। সে জায়গায় পরিবর্তন আসে ২০১১ সালের শেষে। চিনিগুঁড়ার জায়গায় আসে বাসমতি চাল। এই পরিবর্তনের সূচনা ঘটে 'কোলকাতা কাচ্চি ঘর' এর মাধ্যমে।
সে সময় বাসমতি চালের প্রচলন ছিলো বিয়ে বাড়িসহ বিভিন্ন দাওয়াত বা বড় অনুষ্ঠানে। কোলকাতা কাচ্চি ঘর বাণিজ্যিকভাবেই কাচ্চির চাল হিসেবে বাসমতিকে বেছে নেয়।
সেটা ২০১১’র নভেম্বরের কথা। দোকানের মালিক ইশতিয়াক হোসেন জানান, ৩ নভেম্বর বাসমতি চালের অল্প পরিমাণ কাচ্চি নিয়ে আবুল হাসনাত রোডে স্বল্প পরিসরে চালু হয় এই দোকান।
কিছুদিন যেতে না যেতেই বাসমতি চালের সুগন্ধ ও কাচ্চির নরম তুলতুলে মাংসের কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে দোকানটি। তবে কোলকাতার কথা নামে উল্লেখ থাকলেও সত্যিকার অর্থে কোলকাতার সঙ্গে এর কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।
তবে পরোক্ষভাবে কোলকাতার ছায়া আছে। কোলকাতায় হায়দারাবাদি বিরিয়ানি বা দম বিরিয়ানি খুব জনপ্রিয়। কাচ্চিতে মোগল ঐতিহ্যবাহী রেসিপি অনুসারে চিনিগুঁড়া/ কালোজিরা চাল থাকার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে ইশতিয়াক যে বাসমতি চাল ব্যবহারের চিন্তা করলেন, সেটি মূলত দম বিরিয়ানির চাল। 'দম পোক্ত' নামে যে পদ্ধতিতে এই বিরিয়ানি রাঁধা হয়, তাতে বাসমতি চালের সঙ্গে সব মশলা ও মাংস দিয়ে হাঁড়ির মুখ আঠা এঁটে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর কয়েক ঘণ্টা ব্যাপী চুলার আঁচে রাখা হয়। এটিই 'দমে রাখা।' এভাবে তৈরি হয় বিরিয়ানি।
কাচ্চির সঙ্গে এর প্রস্তুত প্রণালির মিল আছে। এক্ষেত্রে প্রচলিত ধরনের বাইরে ভিন্ন স্বাদ এনে দেবার জন্যই ইশতিয়াক ঠিক করেন কোলকাতার ধরনে দম বিরিয়ানির চাল দিয়ে রাঁধা হবে কাচ্চি। আর দোকানের নামটিও এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হয় 'কোলকাতা কাচ্চি ঘর।'
কাচ্চিতে সাধারণত সিনা ও রানের চাকা মাংস ব্যবহৃত হয়। ২০১৫ সাল থেকে এক্ষেত্রে নতুন আইটেম নিয়ে আসেন তারা। সেটি 'খাসির লেগ পিস কাচ্চি।' মুরগির রান যে ধরনে কাটা হয়, সেভাবে বড় করে খাসির রানের পিস তৈরি করে তা পরিবেশন করা হয় কাচ্চির সঙ্গে।
দোকানটির মূল শাখা সাত রওজায়, আবুল হাসনাত রোডে। পরে ধানমণ্ডি ১৫ এর কেয়ারি প্লাজায় একটি শাখা খুললেও তা এখন বন্ধ রয়েছে।
দোকান আকারে ছোট৷ একবারে হয়ত ১০-১২ জন বসতে পারবেন। তবে কাচ্চির স্বাদ নেয়ার জন্য ভিড় লেগেই থাকে এখানে। প্রতিদিন সকাল ১১ টা থেকে রাত ৯ টা / সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত স্বাদ নেয়া যাবে এখানকার কাচ্চির।
কাচ্চির রান্নায় চাল হিসেবে মোগল ধাঁচের বাইরে গিয়ে বাসমতি চাল ব্যবহার করলেও রন্ধনপ্রণালিতে পুরান ঢাকায় প্রচলিত কাচ্চির ধাঁচই ব্যবহৃত হয়। কাচ্চি বিরিয়ানিতে কাঁচা মাংস ও চাল একসঙ্গে হাঁড়িতে চাপিয়ে মুখ এঁটে দেয়া হয়। আলাদা মসলা দেয়া হয় কম। সিদ্ধ হতে হতে মাংসের কষ মিশে যায় বিরিয়ানির সঙ্গে, যা চাল-মাংসের উপভোগ্য রসায়ন তৈরি করে।
কোলকাতা কাচ্চি ঘরের কাচ্চিতে এদিকটি মাথায় রেখে মসলা ও বাড়তি রং ব্যবহারে সতর্ক থাকা হয়। ঝরঝরে বাসমতি পোলাওয়ের সঙ্গে সুসিদ্ধ মাংস পাবেন। নেই মসলার বাড়াবাড়ি। হায়দ্রাবাদি দম বিরিয়ানি ও ঢাকাই কাচ্চি- দুটি রেসিপির স্বাদ মিশে আছে এখানকার কাচ্চিতে।
শুধু পুরান ঢাকায় এটি সীমাবদ্ধ থাকুক, তা চাননি ইশতিয়াক। যদিও ধানমণ্ডির শাখা বন্ধ হয়েছে, তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, এমনকি ২০১১-১২ সালে স্থানীয় মার্কেট, দোকানপাট, এমনকি মসজিদগুলোর সামনেও লিফলেট বিলি করেছেন তিনি। উদ্দেশ্য একটিই- যত বেশি সম্ভব মানুষকে এই কোলকাতা ধাঁচের কাচ্চির সঙ্গে পরিচিত করানো। ২০১২ এর জানুয়ারি থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও রয়েছে তাদের সরব উপস্থিতি।
একসময় বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবে বিয়ে বাড়ির খাবার হিসেবে যে বাসমতি চালের কাচ্চির প্রচলন ছিলো, একযুগ পেরিয়ে এখন সেটি হয়ে উঠেছে কাচ্চি রান্নার নিয়মিত ব্যবহৃত চাল। পুরান ঢাকার পুরনো ঐতিহ্যবাহী দোকানগুলোও চিনিগুঁড়ার পাশাপাশি সুগন্ধি বাসমতি চাল ব্যবহার করছে। সীমিত কিছু দাওয়াত অনুষ্ঠানের বাইরে এর ব্যাপক প্রচলনের পথিকৃৎ হিসেবে কৃতিত্বের দাবিদার কোলকাতা কাচ্চি ঘর।
ঢাকার অলিতে-গলিতে এখন প্রচুর কাচ্চির দোকান, বিখ্যাত বিভিন্ন দোকানের নকল শাখাও কম নয়। উপরন্তু, ব্যাপক প্রচলনের কারণে এমন শোনা যায় যে, মান হারাচ্ছে কাচ্চি, হারিয়ে যেতে বসেছে এর স্বাদ।
সে কথা অবশ্য অস্বীকার করেননা ইশতিয়াক। তবে চালে কোলকাতাকে অনুসরান করে স্বাদে ভিন্নতা আনলেও কাচ্চি রান্নার ঢাকাই ধরন থেকে একেবারে দূরেও সরে যাননি তারা। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মোগল ধাঁচ ও কোলকাতার স্বতন্ত্র ধাঁচের মেলবন্ধনে তাদের কাচ্চিতে ঘটেছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়। পরিমিত মসলায় পছন্দমতো মাংস সহযোগে তাই একবেলা এখানে পেটপুরে খাওয়া যেতেই পারে।
mahmudnewaz939@gmail.com