Published :
Updated :
সালটা ২০১৮। কয়েকটি পত্রিকার পাতায় একটি সংবাদকে কেন্দ্র করে সারাদেশে হঠাৎ সাড়া ফেলে বিলটি। সমগ্র দেশের মানুষ বিলটিকে চিনেছে একটি অলৌকিক ঘটনার গুজবকে কেন্দ্র করে।
এক দিন ভোরে কিছু লোক দেখতে পায় সেখানে থাকা জমাট বাঁধা কচু হঠাৎ সরে গিয়ে অনেকটা জায়গা ফাঁকা হয়েছে। এটিকে অলৌকিক ভেবে কিছু মানুষ সেখানে গোসল করে, পানি খেয়ে রোগ থেকে মুক্ত হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গুজব শুনে দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজারো মানুষ কাদামাখা পথ পেরিয়ে নোংরা পানিতে গোসল, গড়াগড়ি ও কাদাযুক্ত পানি সংগ্রহ করতে ভিড় জমায়। এমন কথাও ছড়ানো হয়েছিল, বিলের পানিতে গোসল করলে অথবা পানি পান করলে সবরকম সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ফলে আচমকা তীর্থস্থানে পরিণত হয় বিলটি ।
ফুটেছে লাল শাপলা, চারিদিকে পাখির কলরব। বিলের এপাশ থেকে ওপাশ শুধু চোখ জুড়ানো লাল শাপলার সমারোহ। এ যেন রক্তিম নান্দনিকতার মনোলোভা রূপ। সকালে উদিত সূর্যের আভায় ফুটন্ত লাল শাপলা ও পড়ন্ত বিকালে সূর্যাস্তের দৃশ্য মুহুর্তে যে কারো মন কাড়ে। এমন নান্দনিক রুপ বিরাজ করে ত্রিশালের চেচুয়া বিলে।
বিলটি শাপলা বিল নামে-ই বেশি পরিচিত মানুষের কাছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন ফুলের বিছানা পেতে রেখেছে কেউ। যতদূর চোখ যায়, সবুজের মাঝে লালচে আভা কেবল হাতছানি দেয়। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বিলটি কালচে পানিতে সবুজ পাতার ওপর মাথা উঁচু করে শোভা ছড়াচ্ছে লাল শাপলা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত লাল শাপলা বিলের নাম সাতলা, অবস্থিত বরিশালের উজিরপুরে। তারপর বিখ্যাত সিলেটের ডিবির হাওরের লাল শাপলা। গুণে-মানে-আাকারে এগুলোর মতো না হলেও চেচুয়া বিলের সৌন্দর্য প্রতিদিনই মুগ্ধ করছে ঘুরতে আসা মানুষদের।
লাল শাপলার বিলটিতে মাঝেমধ্যে দেখা যায় সাদা আর বেগুনি শাপলা। এরই সঙ্গে ভাসমান কচু ফুলের সাদা আভা বিলটির রুপ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। বিলে সাঁতরে শাপলা ফুল তুলতে দেখা যায় কম বয়সী কিশোরদের। সূর্যের আলোয় সারাদিন ঝলঝল করে বিলটি।
সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত এখানে প্রচুর শাপলা ফুল ফোটে। অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু এসময় এখানে আসেন। ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৪ কি.মি. দূরে ৫নং রামপুর ইউনিয়নের ২ ও ৩ নং ওয়ার্ড এর ২০ একর জায়গাজুড়ে বিলটি অবস্থিত।
বিলের সৌন্দর্য রক্ষা ও সারাবছর ফুল ধরে রাখতে ফুল তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ময়মনসিংহের একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত হয়েছে দেশজুড়ে। ঘুরতে আসা পর্যটকদের নিজে থেকেই সাহায্য করে স্থানীয় মানুষেরা।
তবে তাদের কিছু অভিযোগও রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, শাপলা ছিঁড়ে দর্শনার্থীরা নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে। কেউ কেউ শাপলা ছিঁড়ে ছবি তুলে কিছুক্ষণ পর আবার ওই বিলেই ফেলে দিচ্ছে। কেউ বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলে, কেউ কেউ নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
পর্যটকদের আনাগোনায় চাঙ্গা হয়ে উঠেছে স্থানীয় অর্থনীতিও। বিলের কল্যাণে অনেকগুলো মাঝি পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। শাপলা বিলের পাশেই গড়ে উঠেছে বাজার। বিলের মাঝখানে আছে বাঁশের ওয়াচ টাওয়ার। ১ ঘন্টার জন্য বিলে ঘুরতে মাঝিরা নৌকা ভাড়া নেয় সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা।
চেচুয়া বিলে ২০২৩ সালে পরিচিত লাল শাপলার দেখা পাওয়া যায়নি। বিলটির পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাল খননের কাজ চলমান থাকার কারণে দর্শনার্থী টানতে পারেনি লাল শাপলার বিল।
স্থানীয় বাসিন্দা ইফতেখার হোসেন রাসেল বলেন,” সূর্য প্রখর হওয়ার পর আস্তে আস্তে বুজে যায় শাপলা ফুল, ফোটে আবার রাতের বেলা। এমন ঘটনার সাক্ষী হতে পর্যটকরাও অনেক সময় অপেক্ষা করেন বেশ রাত পর্যন্ত। এ বছর বিলটিতে ব্যবসা করতে পারেনি স্থানীয়রা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিলটি পর্যটন শিল্পে ভালো করবে।”
বিশাল বিলটির যে অংশে শাপলা ফোটে, সেখানে যেতে বিড়ম্বনাও পোহাতে হয় পর্যটকদের। বিলে যাওয়ার জন্য যাতায়াত ব্যবস্থার পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। অথবা ছোট ডিঙি নৌকায় চেপে বহু কষ্টে যেতে হয়।
তবু দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিলটিতে ভিড় জমান হাজারো মানুষ। শুক্র,শনিসহ সরকারি ছুটির দিনে দর্শনার্থীর ঢল নামে এখানে।