Published :
Updated :
রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম কোনো এক সড়কে দুজন মানুষের মধ্যে চলছে তুমুল বাক বিতণ্ডা, হঠাৎ পাশে থেকে আওয়াজ এলো - আরেহ ভাই! হাত থাকতে মুখে এতো কথা কেনো?
‘হাত থাকতে মুখে এতো কথা কেন? মাইরের উপর কোনো ওষুধ নাই’’ এই লাইনগুলো পরিচিত লাগছে তাই না? লাগার তো কথাই; কারণ, ছোট থেকেই আমরা এই বাক্যটি শুনে এসেছি।
ছোট বাচ্চা দুষ্টুমি করছে তাকে শান্ত করার উপায় গায়ে হাত তোলা, স্কুলে কোনো শিক্ষার্থীকে ভদ্রতা শেখাতে হলে তাকে দিতে হবে বেতের ঘা, রাস্তায় কাউকে ছিনতাইকারী সন্দেহ হলো, ব্যস, দাও গণপিটুনি।
কথায় কথায় যেখানে-সেখানে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিচার করাটাই যেন প্রধান লক্ষ্য। আইনের তোয়াক্কা না করেই নিজের হাতে বিচার করার যে প্রবণতা তাকে বলা হয় মব জাস্টিস। ‘মব’ (mob) শব্দটির অর্থ ‘উন্মত্ত জনতা’ এবং ‘জাস্টিস’ (Justice) শব্দটির অর্থ ‘বিচার’।
‘মব জাস্টিস’ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় উন্মত্ত জনতার বিচার। অর্থাৎ, যেখানে জনগণ আইন কিংবা নিয়মের পরোয়া না করে নিজেরাই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিচারের দায়িত্ব হাতে তুলে নেয়।
কিন্তু, কেন এই উন্মত্ততা? একটি দেশে যখন গণতন্ত্রহীনতা দেখা দেয়, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অধীনে চলে যায় জনগণ, বিচারব্যস্থা যখন অন্ধ হয়ে যায়, মত প্রকাশ যখন প্রবেশ করে চার দেয়ালের মাঝে তখন মব জাস্টিস হয়ে ওঠে জনগণের বিচার করার ভাষা।
মব লিঞ্চিং বলুন কিংবা মব কিলিং প্রতিটিই মব জাস্টিসের চেহারার বিভিন্ন ভাগ মাত্র। মবের মাধ্যমে যে বিচার জোটে তাতে সম্ভাবনা থাকে না অনেকের প্রাণে বাঁচার।
শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিচার করার প্রবণতা দীর্ঘকালের। বাংলাদেশে প্রায় শুনতে পাওয়া যায় মব জাস্টিসের ঘটনা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রাচীনকাল থেকেই মব জাস্টিসের ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়।
৪১৫ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার গণিতজ্ঞ হাইপেশিয়াকে একদল উন্মত্ত জনতা মব জাস্টিসের মাধ্যমে হত্যা করে। ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় ছেলেধরা সন্দেহে বহু মানুষ হয়েছিল মব জাস্টিসের শিকার।
বেশিরভাগ মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে স্বল্প সময়ের মধ্যে, উন্মত্ত জনতা পাগলের মতো সহিংস হয়ে ওঠে বিচার করবার জন্য। কখনো অনুভূতির দোহাই দেবার মাধ্যমে, কখনো বা গুজব ছড়িয়ে, কখনো দীর্ঘদিনের রাগ থেকে, বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্য, চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে দাবি আদায় কিংবা স্বার্থসিদ্ধি; মব জাস্টিস এসেছে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন চেহারায়। মব জাস্টিসের কারণে বাধ্য হয়ে বলতেই হয়- মবের মুল্লুকে স্বাগত বাবুমশাই! এখানে আইন নয়, বরং মবের জৌলুশ চলছে।
প্রথমেই, প্রশ্ন করতে হয় মব জাস্টিস কেন হয়? মূলত সামাজিক অবক্ষয়, রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা দুর্বল হওয়া এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি মব জাস্টিসকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মব জাস্টিস বিষয়টি এতো গভীরভাবে গাঁথা যে চলচিত্র থেকে নাটক বিভিন্ন জায়গায় বারবার ফুটে উঠেছে - কীভাবে মব জাস্টিস মানুষকে ন্যায়বিচার দিতে পারে।
ফলে, মানুষের মনে আরও গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছে তাদের বিচারের হাতিয়ার একটাই- মব জাস্টিস। প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণ যাদের মতামত প্রকাশের জায়গা সীমাবদ্ধ তাদের দ্বারাই মব জাস্টিস বেশি ঘটে থাকে। কারণ, দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তাদের শিখিয়েছে মব জাস্টিস তাদের ন্যায়বিচার পাবার হাতিয়ার।
রাষ্ট্রে জনগণের মানবাধিকার সঠিকভাবে না থাকা, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এবং ভাবনা বিনিময়ের জায়গা না থাকা,শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি এবং পিছিয়ে থাকা জনগণের প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সহিংস হবার প্রবণতা মব জাস্টিসের জন্য দায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক খোরশেদ আলম বলেন– “মূলত বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি, প্রান্তিক জনগণকে ন্যায়বিচার দেওয়া এবং সঠিকভাবে সামাজিকীকরণের মাধ্যমেই মব জাস্টিস নির্মুল করা যেতে পারে।”
মব জাস্টিসের জন্য কেবল রাষ্ট্র কিংবা জনগণ দায়ী না। দায়ী আমাদের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভাবনা এবং সামাজিক পরিবেশ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিও মব জাস্টিসকে বাড়িয়ে দেবার জন্য দায়ী।
একইভাবে পারিবারিক শিক্ষাও দায়ী। ছোটবেলা থেকেই আমাদের ভাবনাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়- বল প্রয়োগের মাধ্যমেই ন্যায়বিচার সম্ভব।
রাজনৈতিক পালাবদল হক কিংবা সাময়িক সন্দেহ মব জাস্টিস হয়ে ওঠে অনেকের প্রাণ হারানোর কারণ। অথচ, অনেক সময় নিরপরাধ মানুষগুলো অন্যের সন্দেহের ফলে শিকার হয় মব জাস্টিসের।
সমাজে মব জাস্টিসের প্রবণতা বৃদ্ধি সেই সমাজের মানুষের ভাবনা এবং নৈতিকতার পতনকে ইঙ্গিত দেয়। একইভাবে, রাষ্ট্রকাঠামো যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে দুর্বল হতে দেয় তবে বেড়ে যায় মব জাস্টিস।
ছোটবেলা থেকেই যখন একটা শিশু দেখে আসে সে কথা না শুনলে তাকে প্রহার করা হচ্ছে কিংবা চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে কাজ আদায় করা হচ্ছে তখন সেও চাপ প্রয়োগকেই কাজ আদায়ের রাস্তা ভাবে। আমাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াও মব জাস্টিসের জন্য দায়ী।
মূলত, সমাজে নৈতিকতা চর্চা বৃদ্ধি, সহনশীলতার চর্চা, যুক্তিভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা প্রান্তিক জনগণের মত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ পারে মব জাস্টিস নামের এই উন্মত্ততাকে চিরতরে বিসর্জন দিতে।
tasnimmahbub996@gmail.com