Bangla
2 months ago

মোনা লিসা: বিশ্বের সর্ব বিখ্যাত শিল্পকর্মটির খ্যাতির পিছনের রহস্য

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

Published :

Updated :

ধরুন আপনাকে বলা হলো একটি পেইন্টিং বা চিত্রকর্মের নাম বলুন, তাহলে আপনার উত্তর কী আসবে? মোনা লিসা, তাই তো? এমনকি যাদের শিল্প নিয়েও বিন্দুমাত্র আগ্রহ কিংবা ধারণা নেই, তারাও সবাই মোনা লিসাকে কমবেশি চেনেন। মোনা লিসাকে চিনেন না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর এই যুগে।

ফ্রান্সের প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে দর্শনার্থীদের ৮০ শতাংশ, যা প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ, শুধুমাত্র মোনা লিসা দেখতে আসেন। দর্শনার্থীদের ভিড় এতো বেশি যে সম্প্রতি ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রো ঘোষণা করেন যে মোনা লিসা তার জন্য আলাদা একটি প্রদর্শনী হল পাবে।

এতকিছুর পর স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন ওঠে, মোনা লিসার বিশেষত্ব কী? কেন মোনা লিসা এতো বিখ্যাত? ইতিহাসবিদরাও একমত নন মোনা লিসা নিয়ে, রয়েছে নানান রহস্য তার খ্যাতির পিছনে।

মোনা লিসার আসল পরিচয় অজ্ঞাত

লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি ১৫০৩ সালে ফ্লোরেন্সে বসবাস করার সময় এই বিখ্যাত শিল্পকর্মটি আঁকা শুরু করেন। কিন্তু প্রায় এক দশক এরও বেশি সময় লেগেছে তার এটি শেষ করতে।

বিখ্যাত শিল্প ইতিহাসবিদ জর্জিও ভাসারি দাবি করেন যে মোনা লিসা আঁকা হয়েছে লিসা ঘেরার্ডিনি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যে সে সময়ের বিখ্যাত রেশম ব্যবসায়ী ফ্রান্সেকো দেল জিওকোল্ডোর স্ত্রী ছিলেন।

তবে লিওনার্দো ফ্রান্সেকোকে বা ঘেরার্ডিনিকে চিত্রটি দেননি এবং ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের জন্য কাজ করার উদ্দ্যেশ্যে ইতালি ছেড়ে যাওয়ার সময় এটি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন।

লিওনার্দো তার আঁকা অন্যান্য শিল্পচিত্রে থাকা নারীদের পরিচয় বলে গেলেও মোনা লিসার ক্ষেত্রে কিছু বলে যাননি স্পষ্ট করে। বর্তমানে আমরা যা জানি সবই অনুমানের ভিত্তিতে বলা।

কিছু ইতিহাসবিদেরর মতে মোনা লিসা ঘেরার্ডিনি নয় বরঞ্চ লিওনার্দোর দূর সম্পর্কের কাজিন ইজাবেলা ডি'এস্তে  নামক একজনের প্রতিকৃতি।

মোনা লিসা ভিন্ন অন্যান্য চিত্রকর্ম হতে

লিওনার্দো তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি মানব শরীর নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া গবেষণা করেছেন যাতে সম্পূর্ণ বাস্তবিকভাবে তার চিত্রে তুলে আনতে পারেন মানব শরীর।

মোনা লিসা আঁকার ক্ষেত্রে লিওনার্দো স্ফুমাতু নামে একটি কৌশল ব্যবহার করেছেন যা একটি ধোঁয়াটে ঝাপসা নরম কোমল ভাব নিয়ে এসেছে চিত্রটিতে এবং মোনা লিসার ত্বককে উজ্জ্বল করেছে।

মোনা লিসার হাসি বাস্তবিক করার জন্য তিনি মুখের পেশী নিয়েও গবেষণা করেছেন। মোনা লিসা আঁকার সময় তিনি সান্তা মারিয়া নুভা হাসপাতালের মর্গে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মানব শরীর অধ্যয়ন করছিলেন, যা তাকে হাসির পিছনে থাকা মুখের পেশীর কার্যকলাপ বুঝতে সাহায্য করেছিল।

মোনা লিসা চুরি হয়েছিল

১৫০০ শতাব্দীতে আঁকা হলেও ১৮৬০ সালের আগ পর্যন্ত মোনা লিসা তেমন বিখ্যাত ছিল না, বর্তমানের মাস্টারপিস হিসেবে খ্যাতি তো মোটেই নয়। তবে তারপর থেকে মোনা লিসা কিছুটা বিখ্যাত হতে শুরু করলেও বর্তমানের মতো বিখ্যাত হয়নি।

মোনা লিসার খ্যাতির পিছনে সবচেয়ে যা বেশি ভূমিকা রেখেছে তা হল এর চুরি। ১৯১১ সালে ল্যুভরে কর্মরত এক কর্মচারী মোনালিসা চুরি করে ফেলেন। এই ঘটনায় উপরের ফ্রান্সের শিল্প মহলে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় এবং ল্যুভরের পরিচালক পদত্যাগ করেন।

পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্রে মোনা লিসা চুরি হওয়ার ঘটনা বেশ জমকালোভাবে রং মিশিয়ে ছাপানো হয়। সংবাদপত্রে এতই জমকালো ভাবে বলা হয় মোনা লিসার কথা যে প্যারিসের মানুষরা ল্যুভরের যেখানে মোনা লিসা ঝুলিয়ে রাখা হয় সেই ফাঁকা জায়গাটিও দেখতে যায়।

মোনা লিসা নিয়ে পোস্ট কার্ড তৈরি করা হয়, পুতুল বানিয়ে বিক্রি করা হয় এবং সে সময়ে নারীদের একটি বিখ্যাত পোশাক মোনা লিসার নামে নামকরণ করা হয়। দুই বছর পর যখন পুলিশ মোনা লিসাকে খুঁজে পায় তখন ল্যুভরে প্রথম দুদিনেই এক লক্ষরও বেশি মানুষ মোনা লিসা কে দেখতে যায়।

মোনা লিসার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৯১৪ সালের মধ্যে মোনা লিসা সারা পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তাকে ফিরিয়ে আনার পরের বছর রাশান শিল্পী মালভেজ কম্পোজিস মোনালিসার একটি কোলাজ তৈরি করেন "কম্পোজিশন উইথ দ্যা মোনা লিসা" নামে। ফার্নান্ড লেগার নামক আরেকজন শিল্পী লা জাকোন্দ অক্স ক্লেস (১৯৩০) নামে আরেকটি চিত্র আঁকেন যেখানে অন্যান্য বিষয়বস্তুর সাথে মোনা লিসাকেও যোগ করা হয়।

মোনালিসা নিয়ে ১৯৮৬ সালে একটি চলচ্চিত্র বানানো হয় যা মোনালিসার সৃষ্টি, পিছনের গল্প ও রহস্য থেকে উদ্দীপিত।

১৯৮৮ তে উইলিয়াম গিবসন "মোনালিসা ওভারড্রাইভ"  নামক একটি উপন্যাস লিখেন। ১৯৯৯ সালে র‍্যাচেল ওয়াইট "মোনালিসা স্মাইলড এ লিটল" নামক একটি বই লিখেন যা মোনালিসা থেকে অনুপ্রাণিত।

মোনা লিসার ব্যবহার 

১৯৬০ এর দশকের পর শিল্প বিপ্লবের ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়। তখন বিশ্বজুড়ে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোনা লিসা পণ্যের প্রচারণায় নিয়মিত ব্যবহৃত হতো। ১৯৭০ এ মোনা লিসা প্রতিবছর প্রায় ২৩ টি নতুন পণ্যের বিজ্ঞাপনের ব্যবহৃত হত এবং পরবর্তী দশকে সংখ্যাটি প্রতিবছর প্রায় ৫৩টিতে আসে। মোনা লিসার মোহনীয় হাসি বিজ্ঞাপিত পণ্য এবং মোনা লিসা, উভয়েরই জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে। 

বর্তমানে টি-শার্ট থেকে শুরু করে মগ কিংবা স্টিকার, বিভিন্ন কিছুতেই মোনালিসার প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হচ্ছে। শিল্প নিয়ে শৌখিন মানুষরা তাদের ঘরের দেওয়ালেও ঝুলিয়ে রাখছেন মোনা লিসার প্রতিকৃতি।

samiulhaquesami366@gmail.com

Share this news