Published :
Updated :
ডিজিটাল ফাইন্যান্সকে অবহেলার ফলে প্রতিনিয়ত মোটা অংকের খেসারত গুণতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। নগদ লেনদেন ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশটি প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। এর মূল কারণ একটি শক্তিশালী নগদ অর্থ বিহীন অবকাঠামো, নীতিমালা, ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং গ্রহণযোগ্যতার অভাব।
এই ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে অপ্রয়োজনীয় নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা ছাঁটাই যন্ত্র, সরকারি টাকশাল পরিচালনা এবং নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যয়।
সম্প্রতি ঢাকায় এক হোটেলে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আয়োজিত একটি মুদ্রানীতিবিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান মনসুর এই বিশাল অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের কথা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, দেশে ক্যাশলেস অর্থনীতির দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া জরুরি, যাতে করে বেহিসাবি অর্থনীতি বা ‘ইনফর্মাল সেক্টর’ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়—যা প্রায়ই দেশের মূল অর্থনীতির চেয়েও বড় বলে ধারণা করা হয়।
গভর্নর আরও বলেন, "ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা উৎসাহিত করতে হলে ক্রেডিট কার্ডের সীমা বাড়াতে হবে, যাতে এটি ব্যবহারকারীদের জন্য আরামদায়ক হয়। "
তিনি জানান, ডিজিটাল অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি সহজ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ক্রেডিট কার্ডধারীদের জন্য ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছে।
ড. মনসুর মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)-এর পরিধি বাড়ানোর ওপর জোর দেন, যদিও তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন—বেশিরভাগ সেবা এখনও পর্যাপ্তভাবে সক্রিয় নয় বা গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে পারে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, একটি ১,০০০ টাকার নোট ছাপাতে ব্যয় হয় প্রায় ৫ থেকে ৬ টাকা। এছাড়াও, প্রতিবছর দেশের মোট ব্যাংকনোটের প্রায় ১৩ শতাংশ পুনরায় ছাপাতে হয়, যেগুলো ছেঁড়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়।
তবে এই কর্মকর্তা স্বীকার করেন, দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে সম্পূর্ণ ক্যাশলেস অর্থনীতি আপাতত বাস্তবসম্মত নয়।
শনিবার দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ক্যাশলেস সমাজ গঠনের প্রয়াসের পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল সুরক্ষা জোরদার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, "একটি ক্যাশলেস অর্থনীতি কেবল স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না, বরং অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে—যা আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকার অন্যতম কারণ।"
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, কিছু নির্দিষ্ট লেনদেনে অতিরিক্ত নগদ ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে নিয়মতান্ত্রিক প্রণোদনা চালু করা উচিত।
তিনি বলেন, "আমরা ডিজিটাল লেনদেনে ভারত ও থাইল্যান্ডের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। এই রূপান্তর অবশ্যই ধাপে ধাপে হতে হবে। সঠিক নীতিমালা, উপযুক্ত বিধিনিষেধ, পেমেন্ট-ভিত্তিক ডিজিটাল পণ্য, শক্তিশালী অবকাঠামো, আর্থিক সাক্ষরতা ও নিয়ন্ত্রক প্রণোদনা থাকতে হবে যাতে রূপান্তরটা মসৃণ হয়।"
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের সিইও নাসের ইজাজ বিজয় বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় নগদ লেনদেন কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের সঙ্গে তারা সম্পূর্ণ একমত, কারণ নগদ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত অদক্ষ এবং ব্যয়সাপেক্ষ।
তিনি যোগ করেন, "নোট ছাপা, পরিবহন, নিরাপত্তা, বীমা, সংরক্ষণ, টেলার পরিষেবা ও ছাঁটাই অবকাঠামোর সরাসরি ব্যয় ছাড়াও—যা বাংলাদেশ ব্যাংক ও ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে বহন করতে হয়—এর বাইরেও আরও অনেক বড় অর্থনৈতিক ব্যয় রয়েছে।"
তিনি বলেন, দেশে প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন টাকার নগদ লেনদেন চলমান, যার একটি বড় অংশ ৩৫,০০০টি শাখা, উপ-শাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটে অলসভাবে পড়ে আছে।
ব্যাংকিং খাতের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানায়, দেশের ব্যাপক এটিএম নেটওয়ার্ক, নগদ-নির্ভর লেনদেন এবং বৃহৎ অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির কারণে নগদ ব্যবস্থাপনা এখনও ব্যয়বহুল।
এর মধ্যে রয়েছে নগদ পরিবহন নিরাপত্তা, এটিএমে নগদ সংরক্ষণ, এবং জালিয়াতি প্রতিরোধের ব্যয়।
তবে সাম্প্রতিক পদক্ষেপ, যেমন এটিএম পয়েন্ট কমানো, বড় অঙ্কের উত্তোলনে সীমা নির্ধারণ, এবং লেনদেন পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি—ব্যাংকারদের ব্যয় হ্রাস ও ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করছে।
doulotakter11@gmail.com