Published :
Updated :
কোরবানির ঈদ মানেই কয়েকদিন ব্যাপী ভিন্ন ভিন্ন পদের মাংস রান্না। ভুনা মাংস, কষা মাংস, নল্লি, নেহারি, কলিজা ভুনা, মগজ ভুনা ইত্যাদি নানা পদের বাহারি খাবারের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় কয়েকটা দিন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবার দেখা যায় বিভিন্ন ট্রেডমার্ক মাংস রান্নার পদ্ধতি। মাংস রান্নার পদ্ধতির কারণে দেখা যায় যে এলাকাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দেশব্যাপী। যেমন- চুই ঝাল দিয়ে গরু বা খাসির মাংস রান্নার জন্য দেশব্যাপী খুলনা জনপ্রিয়। চট্টগ্রামে আছে মেজবানি মাংস। আবার সিলেটে দেখা যায় সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস রান্না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের গরুর মাংস রান্নার পদ্ধতি নিয়েই আজকের আয়োজন।
চট্টগ্রামের মেজবানি মাংস
চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনপ্রিয় আয়োজনের নাম মেজবান। মেজবান শব্দটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘মেজ্জান’ হিসেবে প্রচলিত। মেহমানদারি বা অতিথিদের জন্য বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা করাই হচ্ছে মেজ্জান। চট্টগ্রামে সাধারণত কোনো আচার-অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে মেজবানের আয়োজন করা হয়। যেমন কুলখানি, চেহলাম ও বার্ষিকী উপলক্ষে ভোজ। এ ছাড়া আকিকা, খতনা, গায়েহলুদ কিংবা নতুন কোনো ব্যবসা আরম্ভ এবং নতুন বাড়িতে প্রবেশ করলেও কেউ কেউ মেজবানের আয়োজন করে থাকেন।
আর এ মেজবান অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে মেজবানি গরুর মাংস রান্না করা হয়। সব বাবুর্চির দ্বারা এ রান্না হয় না। বিখ্যাত কয়েকজন বাবুর্চির কিছু বিশেষ ও গোপন মসলা আছে। যা মেজবানি মাংসের বিশেষত্ব। তবে এখন অনেক দেশব্যাপী অনেক জায়গায় মেজবানি মাংস খাওয়া যায়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন আধুনিক রেস্টুরেন্ট মেজবানি মাংস পরিবেশন করে থাকে। ঢাকাতেও মেজবানি মাংস পাওয়া যায় অনেক রেস্টুরেন্টে। তবে খাঁটি ও আসল মেজবানি মাংসের জন্য চট্টগ্রামের মেজবানেই যেতে হবে।
চট্টগ্রামের কালা ভুনা
কালা ভুনা আরেক বিখ্যাত গরুর মাংস রান্নার রেসিপি। চট্টগ্রামে এর প্রচলন শুরু হয়। গরু বা খাসি, যেকোনো মাংস দিয়েই কালা ভুনা রান্না করা সম্ভব। তবে গরুর কালা ভুনাই সবার বেশি পছন্দ। চট্টগ্রামের মেজবানে কালা ভুনা একটি প্রখ্যাত আইটেম। বিভিন্ন মেজবানে শুধুমাত্র কালা ভুনা রান্নার জন্য স্পেশাল বাবুর্চি থাকেন।
এখন শুধু চট্টগ্রামের মেজবান নয়, কালা ভুনা পাওয়া যায় সাড়া দেশের বহু রেস্টুরেন্টে। সাদা ভাত, পোলাও কিংবা পরোটা দিয়ে কালা ভুনার স্বাদ অতুলনীয়। এছাড়াও মেইন কোর্স হিসেবেও অনেক সময় কালা ভুনার পরিবেশন হয়ে থাকে।
কালা ভুনা বিখ্যাত এর মুখরোচক স্বাদের জন্য। অনন্য এই স্বাদ আসে মূলত যথাযথভাবে সঠিক মশলার ব্যবহার এবং বিশেষ রন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অনেকে মনে করেন কালা ভুনা মানে হল মাংস অনেক সময় নিয়ে ভাজতে ভাজতে রং বদলে বাদামি বা কালো এবং শুকনা শুকনা করে ফেলা। শুধুমাত্র ভাজার কারণে এর কালো রং আসে না, বরং ধাপে ধাপে মসলার সঠিক ব্যবহারে এ রং হয়। আর কালা ভুনার মাংস একেবারে শুকনো হয় না। ঠিকভাবে রান্না করা হলে একটু রসালো এবং খুবই নরম হয়।
খুলনার চুইঝাল মাংস
খুলনা অঞ্চলে গরু বা খাসির মাংস রান্না করা হয় একটি বিশেষ ধরনের মসলা দিয়ে। একে চুই ঝাল বলা হয়। চুই গাছের পাতা ঝাল হয় না। এর শিকড়, কাণ্ড বা লতা কেটে টুকরো টুকরো করে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। দেড় থেকে ২ ইঞ্চি টুকরা করে কেটে সেটা মাঝখান দিয়ে ফালি করে খাবার রান্নার একটি নির্দিষ্ট সময়ে এটা ব্যবহার করতে হয়। রান্নার পর কিছুটা গলে যাওয়া চুইয়ের টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়।
এর ঝাঁজালো ঝাল স্বাদটাই মূল আকর্ষণ। চুইঝাল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোয় মসলা হিসেবে বহুল পরিচিত। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে চুইঝাল দিয়ে মাংস জনপ্রিয় খাবার।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারে আব্বাসের হোটেল চুইঝাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংসের জন্য দেশ ও বিদেশে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। এছাড়াও জেলাটির জিরোপয়েন্ট ও বেজেরডাঙ্গায় বিভিন্ন খাবারের দোকানে চুইঝালের মাংসের সুনাম দেশব্যাপী ছড়িয়ে গিয়েছে।
ঢাকায় অনেক রেস্টুরেন্টই এখন চুইঝালের মাংস তাদের মেনুতে এনেছে এর জনপ্রিয়তার কারণে। চুইঝাল দিয়ে শুধু গরু বা খাসি না, হাঁসের মাংস, অন্যান্য নিরামিষ সবজিতেও এর ব্যবহার হয় ঝালের জন্য।
সিলেটের সাতকড়া দিয়ে মাংস
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট। অনেক বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানের পাশাপাশি সিলেটের রয়েছে নানা ধরনের বিখ্যাত খাবার। তার মধ্যে একটি হলো সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস। সাতকড়া লেবু জাতীয় একটি ফল।
সিলেট ছাড়া দেশের কোথাও এ ফল দেখা যায় না। আসাম ও সিলেটের জৈন্তাপুরে আদিবাসীরা ফলটি রান্না ও তরকারির স্বাদ বাড়াতে সাতকরার ব্যবহার করে থাকেন। সিলেট অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের রসনার অন্যতম অনুষঙ্গ এ সাতকরা। সিলেটে একে ‘হাতকরা’ নামে ডাকা হয়। সিলেটের পরিসীমা ছাড়িয়ে দেশে-বিদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সাতকরা।
টক আর তিতা স্বাদের সংমিশ্রণে ফলটির ঘ্রাণ অনন্য। দেখতে গোলাকার কমলার চেয়ে বড় আকৃতির ফলটির খোসা পুরু আর শাঁস পরিমাণে খুবই কম। এক সময় সাতকরার চাষ হতো সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাটের জাফলং বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ছাতক, বড়লেখা, কোম্পানীগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া কমলগঞ্জের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ের টিলায়। বাংলাদেশে সাতকরার জনপ্রিয়তা আগের চেয়েও এখন অনেক বেড়েছে। সিলেটি প্রবাসীদের কাছে সাতকরার চাহিদা আর সুনাম দুটোই আছে।
গরুর মাংস রান্না নামানোর আধা ঘন্টা আগে আচারের মতো করে কেটে সাতকড়া দিয়ে দেয়া যায় এতে। সাতকড়ার অনন্য স্বাদে পুরো মাংসের স্বাদই বদলে যায়। এ কারণেই দিনদিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কোরবানির মাংসেও সাতকড়ার ব্যবহার করা হয়।
জামালপুরের পিঠালি
জামালপুর জেলায় একটি বিখ্যাত গরুর মাংস রান্না করার পদ্ধতি রয়েছে। একে পিঠালি বলা হয়। আঞ্চলিক ভাষায় একে ‘মিল্লি’ বা ‘মিঠালি’ ও বলা হয়। ঘন ঝোল এর বিশেষত্ব। অনেকে একে হালিমের সাথে মিলিয়ে ফেললেও, এটি হালিম না।
পিঠালি সাধারণত কুলখানি বা চল্লিশা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়। গ্রামেই এই আয়োজন বেশি হয়। পুরো গ্রামবাসীর দাওয়াত থাকে এসব আয়োজনে। এর বিশেষত্ব হলো মাংস খুব বেশি দেয়া লাগে না পাতে। ঝোল এত ঘন ও সুস্বাদু হয় যে তা দিয়েই পুরো খাবার শেষ করা যায়।
পিঠালি রান্নার ট্রাম্প কার্ড হলো চালের গুড়া। মাংস অর্ধেক রান্না হলে এতে চালের গুড়া মিশিয়ে দেয়া হয়। ফলে ঝোল ঘন হয়ে যায়। স্বাদ ও পরিমাণ- উভয়ই বৃদ্ধি পায়। আর শেষে তেলের বাগাড় দেয়া হয়।
জামালপুরের জেয়াফতের (চল্লিশা) খাবার বলতে সাধারণ মানুষ গরম ভাত, চাল কুমড়া ভাজি ও পিঠালিই বোঝে। সব শ্রেণীর মানুষই তৃপ্তি পায় পিঠালি খেয়ে।
faiyazahnaf678@gmail.com