Bangla
a year ago

অঙ্কের মাস্টার থেকে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন

Published :

Updated :

জেলে সূর্য সেনকে কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরীতে রাখা হতো। একজন কয়েদি মেথর ময়লার টুকরিতে করে নিয়ে জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের দিয়ে আসতেন সেই চিঠি। মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন যে বার্তা পাঠান সেখানে লেখা ছিলো “আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা”। 

সূর্য সেনের অন্যতম সাথী ছিলেন বিপ্লবী অনন্ত সিংহ। তার ভাষ্যে, "কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ! কে জানতো সেই শীর্ন বাহু ও ততোধিক শীর্ন পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে - তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?"

ডাকনাম কালু। পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ।  চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কালু থেকে তার মাস্টারদা হয়ে ওঠার গল্পটা সিনেমার চেয়ে কম নয় কোনো অংশে।

১৯১৮ সালে  তিনি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারে বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত 'উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে' অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এসময় বিপ্লবী দলের সাথে তার সম্পর্ক গভীরতর হয়ে ওঠে এবং শিক্ষকতা করার কারণে তিনি 'মাস্টারদা' হিসেবে পরিচিত হন।

মাস্টারদা আত্মীয়-স্বজনের চাপে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন, বিবাহিত জীবন তাকে নিজের কাজ ও আদর্শ থেকে দূরে ঠেলে দেবে। তাই স্ত্রীর সঙ্গে তিনি একদিনও কথা পর্যন্ত বলেননি। 

বিবাহের তৃতীয় দিনে হিন্দুদের মধ্যে যে ফুলশয্যার প্রথা প্রচলিত আছে সেটিও তিনি পালন করেননি। সেদিন তিনি তার বৌদিকে বলেন যে, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে তার মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি সেদিনই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসেন এবং তারপর স্ত্রীর সঙ্গে আর কোনদিন দেখা করেননি।

১৯১৬ সালে মুর্শিদাবাদের বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সূর্যসেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন। ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। বিপ্লবীরা অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকাতির আশ্রয়ও নিয়েছিলেন। 

১৯২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর দিনের বেলায় সূর্য সেনের নেতৃত্বে রেলওয়ে কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭ হাজার টাকা ছিনতাই করা হয়। পুলিশ বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দেয়। পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের যে যুদ্ধ হয়, তা ‘নাগরথানা পাহাড়খণ্ড যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের পর সূর্যসেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী ধরা পড়েন। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করতে না পারায় তাঁরা ছাড়া পান।

১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল ও জালালাবাদের যুদ্ধে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাদের আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন শহীদ হন। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাকে ধরার চেষ্টা করা হলেও ব্যার্থ হয় সে অভিযান। 

তিনি স্থির করেন ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বে হামলা করা হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, 

"বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পেছনে নেই”।

২৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা সূর্যসেন-এর নির্দেশে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল।

এসবের কারণে, ইংরেজ প্রশাসন সূর্যসেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। পরে, ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অস্ত্রসহ সূর্য সেন  ধরা পড়েন। 

১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্যসেনের ফাঁসি কার্যকর হবার কথা। ব্রিটিশরা হাতুড়ি দিয়ে তার দাঁত ও হাড় ভেঙ্গে দেয়। নির্মম অত্যাচারে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তার অর্ধমৃত দেহটিই  ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। 

তার লাশও আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি। হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি। ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাকে ব্রিটিশ ক্রুজার এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।

শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময় মাস্টারদা একদিন যখন গান শুনতে চেয়েছিলেন তখন সেই জেলের অন্য এক সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। বিনোদ বিহারী গান জানতেন না। তবুও সূর্য সেনের জন্য রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শুনিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের এই গানের কথাগুলো সূর্যসেন হয়তো ধারন করতেন। তাইতো বিপ্লবের পথ থেকে আর সরে আসা হয়নি। আর ব্যর্থ হয়নি তার আত্মোৎসর্গও। বাংলা ও সমগ্র ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল ব্রিটিশদের শাসন থেকে।

shakibtahmid05@gmail.com

Share this news