Published :
Updated :
২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছিল অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত দর্শকনন্দিত সিনেমা "ওপেনটি বায়োস্কোপ।" চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের ভোকাল ও গীতিকার হিসেবে অনিন্দ্য সুপরিচিত। তাদের জনপ্রিয় গান "বন্ধু তোমায় এ গান শোনাবো বিকেলবেলায়"-এ যে নস্টালজিয়া তারা তৈরি করেছিলেন, তারই চিত্র যেন আরও বেশি করে ফুটে উঠেছে এই সিনেমায়।
সিনেমার সময় গত শতকের নব্বই দশক। ফোয়ারা নামের এক দুরন্ত কিশোর শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তার বোর্ডিং স্কুল থেকে ফিরে আসে মায়ের কাছে। ফোয়ারার বাবা নেই, সংসারে কেবল মা আর সে।
তার ফিরে আসার পর পাড়ার ছেলেপেলের সাথে পরিচয়, বিচিত্র অভিজ্ঞতা, দুরন্ত দস্যিপনা, জীবনে প্রথমবারের মতো আসা প্রেম আর ফোয়ারার ভালোবাসা ফুটবল- এই সবকিছু মিলিয়ে জমজমাট হয়ে ওঠে "ওপেনটি বায়োস্কোপ।"
নব্বই দশকের কথা বলতে গেলে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। তখনও নগর রাজধানী এতটা মেট্রোপলিটন হয়ে ওঠেনি, শুরু হয়নি বহুতল ভবন আর ফ্ল্যাটের কালচার। তখনও সেখানে বেশ ভালোভাবেই বিরাজমান "পাড়া কালচার।" সেই পাড়ায় মানুষেরা একে অপরকে চেনে, খোঁজ-খবর রাখে। পূজোয় পাড়ার ক্লাবে নাটক হয়, শাহরুখ খানের সিনেমা দেখতে ছেলে-ছোকরারা দলবেঁধে হলে যায়। আর তার সাথে আছে আরেক উন্মাদনা- ফুটবল।
ইস্টবেঙ্গল- মোহনবাগানের দ্বৈরথ আর সে নিয়ে পাড়াজুড়ে সাজসাজ রব- সে তো রয়েছে আরো বহু আগে থেকেই; নব্বই দশকেও সেই আমেজ মুছে যায়নি। এর সঙ্গে ছিলো স্থানীয় ক্লাবগুলোর দাপটও। পাড়ার মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলো ফুটবল।
সিনেমায় ফোয়ারা (রিদ্ধি সেন) এর সাথে পরিচয় ঘটে কচুয়া (ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়), চরণ (ধী মজুমদার), গোপা (রাজর্ষি নাগ) এর। তাদের একসাথে করা নানান অ্যাডভেঞ্চার মাঝবয়েসী মানুষদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাদের কৈশোর ও তারুণ্যের সেই দিনগুলোতে।
এটা সেই সময়ের গল্প, যখন মোবাইল আসেনি। তখনো দূর-দূরান্তে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম চিঠি। আর আছে টেলিফোন। তাতে হয় যোগাযোগ। আজকের দিনের মতো ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার তখন ছিলো না। তাই কাউকে ভালো লাগা, প্রেমে পড়া, তার সাথে দেখা করা, একটা বিকেল একসাথে সময় কাটানো- এসবও ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য।
সিনেমায় ফোয়ারার জীবনেও প্রেম আসে। তিতির (সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়) এর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। কিশোর ফোয়ারার জন্য এ এক নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অনুভূতি। নদীর পাড়ে বসে প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলা, তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা আর তাকে ইমপ্রেস করতে নিজের কণ্ঠে জীবনমুখী গান গাওয়ার চেষ্টা!
সিনেমায় ব্যবহৃত "তোর জন্য" গানটিতে যেমন গাওয়া হয়-"মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে, তোকে ছোঁব সাধ্য কই!" এই প্রেম ফোয়ারার জীবনে আসে একদমই নতুন এক অভিজ্ঞতা হয়ে। এ যেন কৈশোর থেকে একজন তরুণে ক্রমশ পদার্পনের ধাপ৷ জীবনে প্রথম 'চুম্বন'-এর অভিজ্ঞতাও ফোয়ারা অনুভব করতে পারে এই সম্পর্ক থেকেই।
এভাবে যখন সময়টা ভালোই কেটে যাচ্ছিল, তখন আবার উত্থান-পতন এলো ফোয়ারার জীবনে। তার মা (সুদীপ্তা চক্রবর্তী) সম্পর্কে নতুন সত্য আবিষ্কার করা (যা এতদিন তার চোখের আড়ালে ছিল), মা-কে নিয়ে নিজের ভেতর টানাপোড়েন সৃষ্টি হওয়া, ফোয়ারার জন্মের আগেই গত হওয়া বাবাকে নিয়ে অজানা কিছু সত্য জানতে পারা- এসবকিছুই ফোয়ারাকে নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
আর তার সাথে সাথেই চলে আসে ফুটবল। পিতা আর নেই, কিন্তু পিতার লিগ্যাসি হয়ে পুত্রের সামনে রয়ে যায় ফুটবল। রক্তের উত্তরাধিকারের মতো ফুটবল পায়ে মাঠে ছোটা ফোয়ারার মধ্যে যেন নতুন করে তার পিতাকে আবিষ্কার করা যায়।
এরকম আরও নানান ঘটনা ঘটতে থাকে ছবিজুড়ে। প্রিয় এক বন্ধুকে হারানো, দখলদারদের হাত থেকে পাড়ার ক্লাবকে বাঁচানো আর সে জন্য অবলম্বন হিসেবে আবির্ভূত হয় ফুটবল।
বাদবাকিটা দর্শকেরা দেখতে পাবেন সিনেমাতেই। বর্তমানে দুই ঘণ্টা সতেরো মিনিটের সিনেমাটি ইউটিউবেই আছে। এর বাইরে ওয়েব প্ল্যাটফর্মেও মুক্তি পেয়েছে।
তবে দশ বছর পেরিয়ে এসেও এখনও "ওপেনটি বায়োস্কোপ" একইভাবে দর্শকদের স্মৃতিকাতর করে তুলতে পারে৷ পরিচালক হিসেবে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের মুন্সিয়ানা কিংবা কুশীলবদের অভিনয় তো রয়েছেই, তার সঙ্গে ফ্রেমবন্দী করে রাখা হয়েছে নব্বই দশককে।
তাই আজ যারা মধ্যবয়সী বা প্রৌঢ়ত্বে উপনীত, তারা যেমন অনুভব করতে পারবেন হারিয়ে ফেলা সেই সময়টাকে, তেমনি এ প্রজন্মের কিশোর কিংবা তরুণরাও দেখতে পাবেন ফেলে আসা নব্বই দশকের সজীব রূপ ও নির্যাস। তাই মুক্তির দশ বছর পরেও ওপেনটি বায়োস্কোপ এখনো তার আবেদন রেখেছে একইরকম সতেজ হয়ে।
mahmudnewaz939@gmail.com