Published :
Updated :
অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার বা যাকে সংক্ষেপে ডাকা হয় ওসিডি, এক ধরনের মানসিক অসুখ। এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষ কোনো কিছুর প্রতি অবসেশন বা অনর্থক চিন্তার পুনরাবৃত্তি এবং সেই চিন্তা অনুযায়ী কাজ করার ইচ্ছার কম্পালসিভ বিহেভিয়ারের চক্রের মাঝে আটকে যান। একই কাজ বারবার করা ও একই ধরনের চিন্তার মাঝে ব্যক্তি ঘুরপাক খেতে থাকেন যা এক সময় মানসিক চাপের সৃষ্টি করে এবং স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ব্যাহত করে। ওসিডিকে বাংলায় শুচিবাই বলা হয়ে থাকে।
ওসিডিতে আক্রান্ত ব্যক্তির একই কথা, চিন্তা, গল্প, ঘটনা, কাজ, ধারণা বারবার আসতে থাকে, যাকে অবসেশন বলা হয়ে থাকে। কোনো কথা বা কাজের এই অবসেশন কে কাটানোর জন্য যখন কোনো কাজের পুনরাবৃত্তি করা হয় তখন সেটা কে বলা হয় কম্পালশন বা কম্পালসিভ বিহেভিয়ার।
রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট-এর একটি গবেষণায় বলা হয়, ওসিডির ৩টি মূল অংশ রয়েছে। প্রথমটি হলো অবসেশন। যে বিষয়গুলো নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা সেটাকে বলা হচ্ছে অবসেশন। দ্বিতীয় টি হলো ইমোশন বা কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা এবং উদ্বিগ্ন থাকা। তৃতীয়টি হচ্ছে কম্পালশন অর্থাৎ কোনো বিষয়ের প্রতি অবসেশন কাটানোর জন্য যে কাজ করা হয়ে থাকে।
অবসেশন অনুযায়ী কম্পালসিভ বিহেভিয়ারের পার্থক্য হয়ে থাকে। যেমন সেটা হতে পারে বারবার হাত ধোয়া, কোনো কিছু অপরিষ্কার ভেবে বারবার পরিষ্কার করা, বাসার বাহিরে যাওয়ার সময় বারবার দরজা লাগানো হয়েছে কিনা দেখা, একই গণনা বারবার করা ইত্যাদি। অনেকে এ সকল কম্পালসিভ বিহেভিয়ার নিয়ন্ত্রণে আনতে অবসেশন গুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অধিকাংশ সময় এর ফলে অবসেশন আরো প্রকট আকার ধারণ করে এবং আরো বেশি কম্পালসিভ কাজ গুলো করতে থাকে। এই চক্র চলতেই থাকে।
ওসিডির সাধারণ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। নিজের বা পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি হওয়ার চিন্তা, হাতে, শরীরে, আসবাবপত্রে জীবাণুর বা ময়লা লেগে থাকা, বারবার হাত ধোয়া ও গোসল করা, একই কাজ বারবার করা, যেমন- বাসার বাহিরে যাওয়ার সময় লাইট-ফ্যান বন্ধ করা হয়েছে কি-না, গ্যাসের চুলা বন্ধ করা হয়েছে কি-না, কোনো কাজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার চিন্তা, নিজের অবহেলার জন্য কারো ক্ষতি হবার চিন্তা, কোনো কাজ নিখুঁতভাবে করার চিন্তা, ইত্যাদি ওসিডির লক্ষণ হতে পারে। এছাড়াও সবকিছু নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে সাজানো, নির্দিষ্ট একটি ভাবনার চক্রে আটকে থাকা এসবও ওসিডির লক্ষণ।
অনেকগুলো কারণে ওসিডি হতে পারে। পরিবারে কারো ওসিডি থাকলে বা মস্তিষ্কের পূর্ণ বিকাশ না হলে, মানসিক চাপ, শরীরে ডোপামিন ও সেরেটনিনের মাত্রার তারতম্য হলে, ইত্যাদি কারণে ওসিডি হতে পারে।
রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট-এর গবেষণায় বলা হয় প্রতি ৫০ জনে একজন ব্যক্তি ওসিডিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন, ‘দ্যা লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ খ্যাত ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, ওসিডিতে আক্রান্ত ছিলেন।
অনেক সময় ওসিডি শিশুকাল থেকেই শুরু হয়। দেখা যায় তারা তাদের খেলনাগুলো নির্দিষ্ট ভাবে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করে। বা কোনো জায়গায় হাঁটার সময় একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিবার পা ফেলতে পছন্দ করে। সাধারণত বড় হলে এ সমস্যাগুলো কমে আসে। অনেক ক্ষেত্রে ওসিডির লক্ষণগুলো বড় হবার পর প্রকাশ পায়। কিছু কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে ওসিডি ধীরে ধীরে কমে আসে তবে মানসিক অবসাদ বা চাপে থাকলে ওসিডির লক্ষণ বেড়ে যেতে পারে।
সময়মতো চিকিৎসা করতে পারলে ওসিডি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ওসিডির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ঔষধ সেবন নয়, সাইকোথেরাপি নেওয়া প্রয়োজন। সাইকোথেরাপি ও ঔষধ একসাথে নিয়মিত চালিয়ে গেলে ওসিডি পুরোপুরি ভালো হয়।
এন্টি ডিপ্রেশন পিল, এসএসআর বা সিলেক্টিভ সেরেটনিন রিআপটেক, ইআরপি বা এক্সপোজার এন্ড রেসপন্স প্রিভেনশন, মেডিটেশন, সিবিটি বা কগনেটিভ বেহেভিয়ারাল থেরাপি ইত্যাদি ওসিডির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
এসএসআর রোগীর সেরেটনিনের মাত্রা স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। ইপিআর রোগীর মানসিক সমস্যাগুলোকে নির্ণয় করে এবং রোগীর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। এছাড়াও নিজের ও পরিবারের সদস্যদের কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে। যেমন মানসিক চাপ কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতিবাচক মানসিকতা এক্ষেত্রে অনেক কার্যকর। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা যাবে না। প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাস ও হালকা ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে। সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
ওসিডির চিকিৎসা সময় সাপেক্ষ। পুরোপুরি সেরে উঠতে রোগীর অদম্য ইচ্ছা ও দৃঢ় সংকল্প প্রয়োজন। এ সময় পরিবারের পাশে থাকা প্রয়োজন।
firuz.nawer@gmail.com