Published :
Updated :
'পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল'- এমন শ্লোকগাঁথা বঙ্গদেশে বেশ পরিচিত। পূর্ব কিংবা পশ্চিম দুই বাংলাতেই সমানভাবে জনপ্রিয় এই পান্তা ভাত। তাই তো বাঙালির হেঁশেল ছাড়িয়ে কবিতা ও গানের মাধ্যমে সাহিত্যাঙ্গনেও পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে এই খাবার।
নগরায়নের এই যুগে হয়তো বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত পান্তা খাওয়ার সেই প্রাচীন রীতির আর সেভাবে প্রচলন নেই। কিন্তু পহেলা বৈশাখ এলে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে পান্তা বানানোর কাজে। গ্রামে তো বটেই, শহরের পাঁচ তারকা হোটেলেও তখন সাড়ম্বরে বিক্রি হয় পান্তা-ইলিশ।
তবে শুধু ঐতিহ্যগত দিক থেকেই নয়, বরং স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও পান্তা ভাতের উপকারিতা জানলে হয়তো অনেকের চোখ কপালে ওঠবে।
সেই সাথে তীব্র গরমে শরীরকে ঠান্ডা রেখে প্রশান্তি দানের বিষয়টি তো আছেই। বিশেষ করে গ্রীষ্মের এই তাপদাহে আপনার খাবারের মেন্যুতে পান্তা ভাতের অন্তর্ভুক্তি স্বাস্থ্য এবং বাঙালিয়ানা দুটোই রক্ষা করবে।
এবার আসা যাক পান্তা ভাতের উপকারিতা প্রসঙ্গে। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী পান্তা ভাতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, জিংক, ভিটামিন বি, ফসফরাসসহ আরও নানাবিধ পুষ্টি উপাদান।
এমনকি সাধারণ ভাত অপেক্ষা পান্তা ভাতে এসব পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বেশি থাকে। ভারতের আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে করা এক গবেষণায় এমন তথ্য ওঠে এসেছে। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেখানকার কৃষি জৈব প্রযুক্তি বিষয়ের অধ্যাপক ড. মধুমিতা বড়ুয়া। পরবর্তী সময়ে এই গবেষণার ফলাফল এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত হয়েছিল।
উক্ত গবেষণায় সাধারণ ভাত এবং পান্তা ভাতের পুষ্টি উপাদানের একটি সংখ্যানুপাতিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। যেমন- ১০০ গ্রাম সাধারণ ভাতে আয়রনের পরিমাণ থাকে ৩.৫ মিলিগ্রাম। অন্যদিকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর সেই ভাতে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৭৩.৯ মিলিগ্রাম।
এছাড়া একই পরিমাণ সাধারণ ভাত এবং পান্তাভাতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ যথাক্রমে ২১ মিলিগ্রাম এবং ৮৫০ মিলিগ্রাম। পাশাপাশি ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম এবং জিংকের পরিমাণও পান্তা ভাতে বেড়ে যায় বলে গবেষণাটিতে ওঠে আসে।
মূলত ফারমেন্টেশনের কারণে এরূপ পরিবর্তন হয় বলে জানান ড. মধুমিতা বড়ুয়া। কারণ, সাধারণ ভাতে ফাইটেটের মতো এন্টি নিউট্রিশনাল ফ্যাক্টর থাকে যার কারণে তা আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম এবং জিংকের মতো পুষ্টি উপাদানগুলোকে বেঁধে রাখে এবং এজন্য খাওয়ার পরেও দেহ এসব পুষ্টি উপাদান শোষণ করতে পারে না। পক্ষান্তরে, পান্তাভাতে ফাইটেট দূর্বল হয়ে পড়ে বিধায় পুষ্টি উপাদানগুলো উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং এই কারণে আমাদের দেহ সেগুলো গ্রহণ করতে পারে।
যেহেতু পুষ্টি উপাদান বেশি, সেহেতু পান্তা ভাতের স্বাস্থ্য উপকারিতাও সাধারণ ভাত অপেক্ষা বেশি। যেমন- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে পান্তাভাত। এছাড়া ক্যালিসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে বিধায় তা হাড় মজবুত করতে ভূমিকা রাখে।
অন্যদিকে পান্তাভাতে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকায় তা রক্তে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া শরীরের প্রদাহ এবং কোলেস্টেরল কমাতেও কার্যকরী ভূমিকা রাখে পান্তাভাত। পাশাপাশি ক্যান্সার প্রতিরোধেও পান্তাভাতের অবদান রয়েছে।
এই বিষয়ে আরও জানতে কথা হয় ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুষ্টিবিদ সিরাজাম মুনিরার সঙ্গে। তিনি বলেন, "পান্তাভাত সবসময়ই আমাদের শরীরের জন্য উপকারী। তবে গরমে এটি শারীরিক প্রশান্তি দেয় বিধায় এই সময়টিতে পান্তাভাত দেহের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হয়ে ওঠে। অন্যান্য অনেক পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি পান্তাভাতে ভিটামিন 'কে' থাকে বিধায় এটি হিটস্ট্রোক প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া এর সাথে যদি পেঁয়াজ-মরিচযোগে খাওয়া হয় তাহলে তা এন্টি-অক্সিডেন্ট তৈরি করে যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।"
তিনি আরও বলেন, "যদিও ৬-১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে পান্তাভাত খাওয়া যায়, কিন্তু এর পরিপূর্ণ পুষ্টি পাওয়ার জন্য ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তবে ১২ ঘন্টার চেয়ে বেশি পানিতে ভেজালে সেখানে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে বলে সেটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠতে পারে।"
পান্তাভাত খাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "পান্তাভাত সব বয়সের মানুষই খেতে পারবেন। এছাড়া পরিমাণমতো খেলে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও এটি কোনো ধরনের সমস্যা তৈরি করে না। তবে যেহেতু পান্তাভাতে একটু বেশি পরিমাণ লবণ দিতে হয় তাই উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের এই বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে এবং দিনের অন্যান্য খাবারের সাথে এই লবণের সমন্বয় করতে হবে যাতে করে অতিরিক্ত লবণ শরীরে না যায়।"
গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরমে অনেকেই খাবারের রুচি হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া ডায়রিয়াসহ নানাবিধ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তো আছেই। তাই এই সময়টিতে শরীরকে ঠান্ডা রেখে রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষকবজ হিসেবে কাজ করতে পারে পান্তাভাত। তখন হয়ত একটি কথা আপনার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাবে। আর তা হলো- বাঙালী সংস্কৃতি শুধু খাবারের স্বাদেই নয়, বরং স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও অনন্য।