Published :
Updated :
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি কবিতা ‘পৌষ পার্বণে' তিনি লেখেন,
আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।
গড়িতেছে পিঠেপুলি অশেষ প্রকার।
বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা।
হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা।
প্রীতম সদ্য দ্বিতীয় শ্রেণির পরীক্ষা শেষে তার দাদুর বাড়ি এসেছে বেড়াতে। তার দাদু শীতের পিঠা বানাচ্ছে। কড়াই থেকে গরম গরম পুলিপিঠা রাখা হচ্ছে। পাশে বসে সে দেখছে আর উদরপূর্তি করছে দাদুর হাতের ধোঁয়া উঠা শীতের সকালের গরম পিঠায়।
গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পৌষ মাসে নতুন চালের গুঁড়ায় পিঠা তৈরি হয় এভাবেই। আর একে বলা হয় ‘পৌষ পার্বণ’। ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর এ রীতি বহু পুরনো। অতিথি এলেও চলে পিঠা দিয়ে তাদের আপ্যায়ন। ধনী-গরিব প্রতিটি ঘরে চলে সাধ্যমতো পিঠা বানানোর তোড়জোড়। এই সংস্কৃতি বাঙালির হাজার বছরের। যতটা না খাওয়ার উৎসব, তার থেকে বেশি অপরকে খাইয়ে আনন্দ পাওয়ার উৎসব এই পৌষ পার্বণ ।
পিঠা খাওয়ার জন্য পৌষ- মাঘই কেন?
ঋতুর হিসেবে এটা শীতকাল। পিঠা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন - নানা রকমের গুড় এ সময় বাজারে আসে। মিষ্টি খেজুরের রস থেকে খেজুরের গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়সহ বিভিন্ন রকমের গুড় এ সময়েই পাওয়া যায়।
গুড় থেকে তৈরি এসব পিঠা খেতে অত্যন্ত মজাদার। কিন্তু গুড় তো শীতকাল ছাড়া পাওয়া যায় না। তাই পিঠা তৈরির জন্য শীতকালই উপযুক্ত। তাছাড়া শীতের সকালের মিষ্টি রোদ আর কুয়াশার মাঝেই পিঠার আসর জমে সবচেয়ে বেশি।
পৌষ পার্বণের পিঠাগুলো
বাংলাদেশের বিশেষ কিছু পিঠার মধ্যে অন্যতম হলো: মালপোয়া পিঠা, সিমুই পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, ঝিনুক পিঠা, চিতই পিঠা, খেজুর পিঠা, বিনুনীর মতন গড়া বেনি পিঠা, ঝাল কুশ পিঠা, মিঠে নকশায় সাজানো নকশাই পিঠা, পাঁপড়ের আকারের মলকো পিঠা, করলা পিঠা, চঙ্গা পিঠা, মুঠা পিঠা ও রস চিতোই পিঠাসহ আরও অনেক পিঠা।
পৌষ সংক্রান্তি:
পিঠার সঙ্গে পৌষ সংক্রান্তি শব্দটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে এই দিনের আগে পিঠা খান না। এই সংক্রান্তি তাই পিঠা উৎসবে পরিণত হয়েছে।
পৌষ সংক্রান্তিকে মকর সংক্রান্তিও বলা হয়। বাংলা পৌষ মাসের শেষ দিনে এই উৎসব হয়। শেষ দিন হলেও সাধারণত দুই-তিন দিন ধরে হরেক রকম পিঠা বানানোর কাজ চলে।
একসময় গ্রাম-বাংলায় বেশ ঘটা করে এই দিন পালনের রেওয়াজ ছিল। তবে এখন তেমন দেখা যায় না সেসব। এই বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে একসময় এ দেশে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আয়োজন করা হতো। তাছাড়া বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই বাজি ফোটানো, ফানুস ওড়ানো এসব আনন্দ উৎসবের ভেতর দিয়ে আনন্দমুখর এ উৎসবের সমাপ্তি ঘটত। পিঠা যে শুধু খাওয়া নয়, বরং সবাই মিলে আনন্দ করার এক অনুষঙ্গ সেটাও টের পাওয়া যায় এই উৎসব থেকে।
বিশ্বজুড়ে পৌষ সংক্রান্তি
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ায় এ সময়টাতে অনুরূপ উৎসব হয়। নেপালে এই দিবসটি মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়।দেশ ভেদে এর নামের মতো উৎসবের ধরনে থাকে পার্থক্য। জানা গেছে, প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও এই দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।
ধর্মগ্রন্হ ও পৌরাণিক কাহিনীতে সংক্রান্তি
পৌরাণিক মতে দেবতাদের দিন শুরু হয় উত্তরায়ণের সাথে সাথে। দক্ষিণায়নের সাথে সাথে শুরু হয় দেবতাদের রাত্রি। দীর্ঘ রাত্রি থেকে দেবতাদের দিনে প্রবেশ করার ক্ষণটিকে উৎসব আকারে পালন করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তবে এ উৎসব পালন নিয়ে রয়েছে নানা মত।
পূরাণ অনুসারে মকর ক্রান্তির এই দিনে অসুরদের সাথে দেবতাদের যুদ্ধের অবসান ঘটে। ঐ দিন বিষ্ণু অসুরদের বধ করে তাদের ছিন্ন মুন্ড (মাথা) মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দেন এবং শুভ শক্তির সূচনা করেন।
মহাভারত ও কালিকাপুরাণ অনুসারে এই মকর সংক্রান্তিতে দেবতাদের আরাধনা করা হয়। আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য এ সময় লক্ষ্মী দেবীর আরাধনাও করা হয়। মল মাসের, অর্থাৎ, র্পৌষ মাসের শেষে এই উৎসব পালনের মাধ্যমে অশুভ শক্তির ত্যাগ আর শুভ শক্তির সূচনা করা হয়।
তিল্লার ঘর কী?
চিড়া, মুড়ি আর পিঠা-পুলি খাওয়ার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে ছোট ছেলে মেয়েরা পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে খড় দিয়ে ছোট ঘর বানায় যাকে বলে তিল্লার ঘর। ঐদিন ছেলে মেয়েরা বাড়ির পাশে ঘর বানিয়ে সেমাই সুজি মাংস রান্না করে চড়ুই ভাতির মতো খাওয়া দাওয়া করে এবং রাত্রি যাপন করে। খুব ভোরে উঠেই স্নান করে তিল্লার ঘর পুড়িয়ে আগুন পোহায়।
বাঙালি কবি লেখকরা তাদের কবিতার ছন্দে বাঙালির এই পৌষ পার্বণকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
সুনির্মল বসু 'পৌষ-পার্বণ উৎসব' কবিতায় লিখেছেন,
পিঠে পিঠে পিঠে,—
ভাবছি যতই খাবার কথা
লাগছে ততই মিঠে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
ঐ চড়েছে রসের ভিয়ান,
আসছে রসের ছিটে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
সেই পৌষ পার্বণ এখনই। দাদুর হাতের গরম গরম শীতের পিঠা খাওয়ার সময় এখনই।
shakibtahmid05@gmail.com