Bangla
a year ago

প্রেমের কবি নজরুল

Published :

Updated :

'বল বীর –

বল উন্নত মম শির!

শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!'

 

এই একটি কবিতা কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবির আখ্যা দিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে পরাধীন দেশে তিনি হয়েছিল কারাভোগী। আপাংক্তেয় মানুষের অধিকারের কথা তুলে ধরতে তার কলম সদা সোচ্চার ছিল। কিন্তু এসবের কোনো কিছু এই মানুষটিকে শুধু বিদ্রোহের কবি করে রাখেনি, ছাপিয়ে যায়নি তার প্রেমিক সত্ত্বাকে। প্রেম যে বিদ্রোহের শুদ্ধরূপ, তা কবির কবিতা-গানে মর্মে মর্মে গাঁথা। তাতে আজো মধুর বাঁশুরী বাজে। বরং বলা চলে আমাদের এই বিদ্রোহী কবি আদতে পুরো দস্তুর প্রেমের কবি। 

আর তারই ঝংকার- মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আরেক হাতে রণ-তুর্য। 

সত্য সুন্দরের কবি আজীবন ছিলেন প্রেমের কাঙাল। তার জীবনে প্রেম এসেছিল বারবার, তবে তা বিরহই রচনা করেছে অধিক। তাই কবির সুরে বিরহের বেহাগ বাজে। একমাত্র প্রমীলা দেবী কবির প্রণয় কুসুমকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন চিরকাল। 

কবির জীবনমরুতে প্রথম প্রেমের বারি সিঞ্চিত করেছিল কুমিল্লার এক গ্রামীণ কিশোরী। কবি তার শুভ্র অতুল সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার প্রথম প্রেমকুসুমকে নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। 

১৯২১ সালের মার্চে আলী আকবর খানের আহ্বানে কুমিল্লার দৌলতপুর আসেন কবি। সেখানে পরিচয় ঘটে সৈয়দা খাতুনের (এনাকেই কবি নার্গিস নাম দেন) সাথে। কিছুদিনের মধ্যে সেখানে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান বসে। তাতে গানের আসরে গান ধরেন নজরুল। গান শুনে নার্গিসের মন বসে যায় নজরুলে। নজরুলও ধীরে ধীরে নিজেকে নার্গিসের মধ্যে হারিয়ে ফেলেন। তাদের প্রণয় রেখা গাঢ় হতে থাকে। পাত্র হিসেবে নজরুলকে নার্গিসের পরিবারের মনে ধরে। নজরুল নিজেই বিবাহের প্রস্তাব করতেই তারা আর কথা মাটিতে পড়তে দেয়নি, বিবাহের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। ধুমধামে শাদী মোবারক হয়। কিন্তু বিবাহ আসরে যেই প্রস্তাব ওঠে পাত্রকে ঘরজামাই থাকতে হবে, স্বাধীনচেতা কবির মন আর তাতে সাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। তিনি সেই রাতেই এক চিঠি ফেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। আর বাসর বসেনি নজরুল- নার্গিসের। আর কখনো দেখাও হয়নি।

এই বিচ্ছেদ নজরুলের মনে বড় দাগ কেটেছিল। প্রথম নার্গিসকে তিনি ভুলে যেতে পারেননি সহজে। তার গানে কবিতায় এই বিরহ ছবি এঁকেছে। এ ঘটনার চোদ্দ বছর পরে নার্গিস একদিন কবিকে চিঠি দিয়েছিল। কবি সে চিঠি প্রত্যুত্তর করেছিলেন এভাবে–

‘যার হাতে দিয়ে মালা দিতে পার নাই

কেন মনে রাখ তারে, ভুলে যাও তারে, ভুলে যাও একেবারে,

আমি গান গাহি আপনার দূঃখে

তুমি কেন আসি দাঁড়াও সন্মুখে

আলেয়ার মতো ডাকিওনা আর নিশিথ অন্ধকারে।’

এ যেন ছিল পেয়েও না পাওয়া।

কবি এরপরে মজেছিলেন ফজিলাতুন্নেছার প্রেমে। ফজিলাতুন্নেছা জোহা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকত্তোর মুসলিম ছাত্রী। এনাদের পরিচয়ের যোগসূত্র ছিলেন কবিবরের বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী। কবির একখানা প্রতিভা ছিল, তিনি জ্যোতিষীবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত। একদিন মোতাহার হোসেন কবিকে নিয়ে যান ফজিলাতুন্নেছার বাড়িতে হাত দেখতে। এই হাত দেখাদেখিতে চোখে চোখে কথা হয়ে যায়। কবি তাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেন। এরপরই কবি যেন নিজের হৃদয় খুলে চিঠিতে পাঠিয়ে দেন ফজিলাতুন্নেছার কাছে। কিন্তু তার থেকে কোনো সাড়া আসেনি। কবির প্রেম রয়ে যায় একতরফা। অভিমানী কবি আর কোনোদিন সরাসরি চিঠি দেননি, তবে হাল ছাড়েননি। উত্তর পাবেননা জেনেও চিঠি পাঠাতেন বন্ধুর মারফত। বন্ধু জিগ্যেস করে কেন তুমি ওকে নিজে হাতে চিঠি দাও না। কবি বলেন, প্রথম চিঠির যে উত্তর উনি করেছেন, তাতে মনে হয় না জীবনে তিনি কখনো আমায় দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে করুণা করবেন। কবির প্রত্যুত্তর না পাওয়া চিঠিগুলিতে বারবার তার হৃদয়ক্ষত রণিত হয়েছেন। কবি ভেঙে গিয়েছিলেন হৃদয় থেকে। সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে। তাকে উদ্দেশ্য করে বন্ধুকে লেখা শেষ চিঠিতে বলেছিলেন, তাকে বলো যেদিন আমি মারা যাবো সেদিন যেনো এ চিঠিতে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন করে সে যেন আমার তর্পণ করে।

ফজিলাতুন্নেছা নজরুলের প্রেমকে নাকচ করে ছিলেন বটে, কিন্তু তিনিও তার শেষ জীবন নিঃসঙ্গে কাটিয়েছিলেন।

কুমিল্লাতে যতবারই আসা হতো ততবারই নজরুল আতিথ্যেয়তা নিতেন সেনগুপ্ত বাড়িতে। বাড়ির সকলের মতন বিরজা দেবী নজরুলকে করতেন পুত্রের মতন স্নেহ। এই বাড়িতে কন্যা আশালতাকে নিয়ে আশ্রিত ছিল বিরজা দেবীর জা গিরিজা দেবী। তিনিও নজরুলকে যারপর নাই ভালোবাসতেন। কিন্তু ছিলেন সহায় সম্বলহীন। বাড়ে বাড়ে এই বাড়িতে আসা যাওয়ার ছলে আশালতার সাথে নজরুলের প্রগাঢ়তা বাড়তে থাকে। নজরুল ভালোবেসে তাকে প্রমীলা ডাকতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের ভালোবাসা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। মেয়ে নিয়ে গিরিজা দেবীকে বাড়ি ছাড়া হতে হয়। নজরুলকে শিকার হতে হয় সামাজিক নেতাদের হিংসার। কিন্তু তবুও তারা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন ১৯২৪ সালে। কেউই নিজের ধর্ম বদল করেননি। গিরিজা দেবী নিজে বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রমীলা দেবী সারাজীবন নজরুলকে ছায়ার মতন আগলে রেখেছেন। তিনিই চার নজরুল পুত্র : কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধের জননী। 

'ওগো জীবন-দেবী।

আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,

আজ বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!

আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে,বিজয়িনী!   

 নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,

   যত তৃণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে’,

          আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে  ভেসে।।'

 

(প্রমীলা দেবীকে উদ্দেশ্য করে লেখা বিজয়িনী কবিতার অংশ)

কবি চিরকাল প্রেমের পূজারী। প্রেমের পূজার লাগি চয়িত পুষ্পে অর্ঘ্য ভরেছেন ডালিতে। পিকজ নামক মরণব্যাধিতে বাক শক্তি হারাবার আগে কবি অংশ নিয়েছিলেন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির আয়োজিত এক  বিশেষ সভায়। সেখানে কবির মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল, "আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম নিতে এসেছিলাম।সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।"

 

সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

[email protected]

Share this news