Published :
Updated :
একজন ব্যক্তির সুস্থভাবে জীবনযাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে পরিবেশের গুরুত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। একটি সুন্দর পরিবেশ শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যই নয়, সুস্থতা কিংবা ব্যক্তিত্বের বিকাশেও ভূমিকা রাখে। তবে খুব কম মানুষই আছে যারা পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে।
পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের- এমন মনোভাব দেখা যায় এদেশের বেশিরভাগ মানুষের মাঝে। অথচ ব্যক্তি সচেতনতা সৃষ্টি না হলে শুধু সরকারি প্রচেষ্টায় পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা শুধু কঠিনই নয়, রীতিমতো অসম্ভব।
প্রতি বছর ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। এদিন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান কিংবা র্যালির আয়োজন করা হয়৷ এছাড়া দিনটি উপলক্ষ্যে গণমাধ্যমেও থাকে বিশেষ প্রতিবেদন। অথচ এতো কিছু করেও যেন পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে যততত্র ময়লা-আবর্জনা, গাড়ির অতিরিক্ত হর্ন, কিংবা গাছ কেটে নগরায়নের প্রবণতা- এসবকিছুই পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিশেষ করে ঢাকা শহরের বায়ু দূষণ ইতোমধ্যে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে।
এসব কার্যাবলীর কারণে পরিবেশ যেমন তার ভারসাম্য হারাচ্ছে, ঠিক তেমনি মানব শরীরে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি ছড়ানোর প্রকোপও দিনদিন বাড়ছে। বাংলাদেশে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু আইনও প্রণীত হয়েছে। কিন্তু এতে করেও পরিবেশ দূষণ কমানো যাচ্ছে না। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে একটি মনোরম পৃথিবী উপহার দিতে পরিবেশ সুরক্ষায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
পরিবেশ সুরক্ষার প্রাথমিক পদক্ষেপ আমাদের নিজেদের বাসস্থান থেকেই শুরু করতে হবে। আমরা যেখানে বাস করি তার চারপাশ সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন রাখা আমাদের দায়িত্ব। বাসা-বাড়ির ময়লা-আবর্জনা খোলা জায়গায় না ফেলে সিটি কর্পোরেশন কিংবা পৌরসভা কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে ফেলতে হবে। তাহলে ময়লা পঁচে দূর্গন্ধ ছড়াবে না যা আমাদের একটি বাসযোগ্য শহর উপহার দিতে পারে।
তবে দুঃখজনক হলেও এই কথা সত্যি যে, আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে এখনও রাস্তার মধ্যে খুব একটা ডাস্টবিন দেখা যায় না। ফলে বাধ্য হয়েই অনেকে প্যাকেটজাত দ্রব্য রাস্তায় ফেলে যা পরিবেশের জন্য মারাত্নক হুমকি। কারণ, এসব প্যাকেট একসময় নালা-নর্দমায় গিয়ে পড়ে সেগুলো ভরাট করে দেয়। ফলশ্রুতিতে এদেশে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে অনেক সামাজিক সংগঠন পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তাদের এই বিষয়টিতে অবশ্যই গুরুত্বারোপ করা উচিত। এছাড়া কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের এই বিষয়টি নিশ্চিতে এগিয়ে আসতে হবে।
উন্নত জীবনযাপনের জন্য অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাসের দিকে ঝুঁকছে। ফলে শহরাঞ্চলে আবাসনের চাহিদাও দিনদিন বাড়ছে। আর এরই সুযোগে অনেকে গাছ কেটে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে যা দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্র তাপদাহ এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও বৃক্ষরোপণ এবং এর তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এছাড়া বাসা বাড়ির ছাদ কিংবা বারান্দায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে সবুজায়নের উপর নজর দিলে সেটি আপনাকে এক ধরনের মানসিক প্রশান্তিও এনে দিবে।
এছাড়া বর্তমানে পাহাড়খেকোদের দৌরাত্ন্য বেড়েছে পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। অনেক সময় স্থানীয় প্রভাবশালীরা সরাসরি জড়িত থাকে এসব কাজে। মনে রাখতে হবে, যেই পাহাড় আমাদের প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা করে সেটি ধ্বংসের মাধ্যমে আমারা কিন্তু নিজেদের ধ্বংসই ডেকে আনছি। এককভাবে এই সমস্যার সমধান করা না গেলেও, সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে সহজেই পাহাড় রক্ষা সম্ভব।
এছাড়া শহরাঞ্চলের একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হলো শব্দ দূষণ। গাড়ির অতিরিক্ত হর্ণ কিংবা মাত্রাতিরিক্ত মাইকিংয়ের ব্যবহার শব্দ দূষণের প্রধান কারণ। শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়াসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি করে শব্দ দূষণ। এটি প্রতিরোধেও ব্যক্তিগত সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্রে এই বিষয়ে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করতে হবে।
স্বভাবগতভাবেই বাংলাদেশের মানুষ ভ্রমণপিপাসু। তাই তো সুযোগ পেলেই দেশের নানা প্রান্তে ছুটে যায় তারা। তবে বিপত্তি ঘটে যখন পর্যটন স্থানগুলোতে পর্যটকরা প্যাকেট, পলিথিন কিংবা খাবারের উচ্ছিষ্ট যত্রতত্র ফেলে রাখে। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয়, ঠিক তেমনি পর্যটন স্থানগুলোর সৌন্দর্যও বহুলাংশে হ্রাস পায়। আর এসব অভ্যাস বন্ধ করতে আইনের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি কার্যকরী হলো ব্যক্তিগত সচেতনতা।
এছাড়া আতশবাজি, উচ্চস্বরে গান বাজানোর মতো ঘটনাগুলোও পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনে। বিশেষত ইংরেজি নতুন বছরকে কেন্দ্র করে থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপনের সময় এই বিষয়গুলো বিশেষভাবে নজরে আসে। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনেকে এই ধরনের কার্যক্রমে মত্ত হয়ে ওঠে। এতে করে প্রাণী কিংবা পাখিকূলকে অবর্ণনীয় দূর্দশার সম্মুখীন হতে হয়। এসব কাজ বন্ধের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
তবে শহরের তুলনায় গ্রামের পরিবেশ কিছুটা প্রশান্তির হলেও সেখানেও বর্তমানে পরিবেশ ধ্বংসের নির্মম খেলা শুরু হয়ে গেছে। নদী দখল, যত্রতত্র ইট ভাটা নির্মাণ কিংবা বনায়ন ধ্বংস করে বসতবাড়ি নির্মাণের প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই শহরের পাশাপাশি গ্রামের পরিবেশ রক্ষায়ও সবাইকে সচেতন হতে হবে।