Bangla
a day ago

পর্যটনে ভিড়, উঁকি দিচ্ছে নতুন সম্ভাবনা

Published :

Updated :

বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত ও মোহনীয় বনভূমির মতো জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলো এখন বিপুল সংখ্যক পর্যটকে পরিপূর্ণ হয়ে পড়ায়, এই দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক খাতে সম্ভাব্য নতুন পর্যটন পণ্য নিয়ে ভাবছে সংশ্লিষ্টরা।

দেশের পর্যটন খাত এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্তম্ভে পরিণত হচ্ছে, যা বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৪ শতাংশ অবদান রাখছে এবং সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ২০ লাখেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।

২০২৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটন খাতের বাজারমূল্য ৩.৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যার মধ্যে রাজস্ব আয় দাঁড়াবে ২.৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এই খাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার হবে হোটেল খাত, যার বাজারমূল্য ২০২৫ সালের মধ্যে ১.২১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তবে পর্যটন বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা মনে করেন, এখন সময় এসেছে টেকসই এবং বিকল্প পর্যটনধারার দিকে ঝুঁকবার—যেমন কৃষিভিত্তিক পর্যটন (অ্যাগ্রো-ট্যুরিজম), গ্রামীণ পর্যটন, সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন ও নদীকেন্দ্রিক পর্যটন।

এসব উদ্যোগ দেশের জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোর ওপর চাপ কমাবে এবং প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদের দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ নিশ্চিত করবে।

তাদের মতে, এসব নতুন ও ভিন্নধর্মী পর্যটনধারা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কারণ মূল পর্যটন কেন্দ্রগুলো—কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন এবং সিলেটের নানা গন্তব্য—পিক সিজনে পর্যটকের ভিড়ে উপচে পড়ে।

এই অতিরিক্ত ভিড় শুধু স্থানীয় অবকাঠামো ও পরিবেশ ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করে না, পাশাপাশি ভ্রমণের মান ও অভিজ্ঞতাও নষ্ট করে দেয়, বলে তারা মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের (টিওএবি) সভাপতি মো. রফিউজ্জামান বলেন,
আমাদের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভিড়ে ঠাসা থাকে পিক টাইমে, ফলে পর্যটকরা অনেক সময়েই যেই প্রশান্তি বা স্বস্তি খুঁজে পান না।

তিনি বলেন, এই কারণেই এখন অনেকে কৃষিভিত্তিক, গ্রামীণ ও সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন, নদীকেন্দ্রিক এমনকি আধ্যাত্মিক পর্যটনের দিকেও ঝুঁকছেন, যেখানে তারা প্রাকৃতিক ও শান্ত পরিবেশ পান।

এই ধরণের পর্যটনধারা যেমন টেকসইতা প্রচার করে, তেমনি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যময় করে তোলে এবং গ্রামীণ এলাকায় অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করে।

তবে পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলেন, এসব বিকল্প পর্যটন ধারাকে বেগবান করতে হলে সরকারের সমন্বিত সহায়তা ও নীতিগত সমন্বয় জরুরি।

রফিউজ্জামান বলেন, দরকারকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে—বিশদ নীতি প্রণয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতকরণে সহায়তা দিতে হবে।

ট্যুর অপারেটররা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষিভিত্তিক ও সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন পর্যটকদের স্থানীয় খামার ঘুরে দেখা, আদিবাসী খাবার উপভোগ করা এবং ঐতিহ্যবাহী 'জুম' চাষ সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়।

অন্যদিকে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন বাংলাদেশের বিস্তৃত নদীজাল ঘুরে দেখার সুযোগ এনে দিতে পারে, যেখানে গ্রামীণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সংস্কৃতি একসাথে সমৃদ্ধ করা যায়।

কাঠমান্ডুভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন প্রকল্প শুরু করেছে, যেখানে স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সরাসরি অংশগ্রহণ এবং উপকৃত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

আইসিমোড-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মো. কবির উদ্দিন বলেন, এই ধরনের পর্যটন হোমস্টে, স্থানীয় গাইডিং, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও হস্তশিল্পের মাধ্যমে স্থানীয় আয়ের পথ খুলে দেয়। 

তবে এখনো পর্যটন খাতে সরকারি সহায়তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ বলেন,
গাজীপুর, বৃহত্তর সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, কিন্তু রাস্তাঘাট ও বুনিয়াদি অবকাঠামোর ঘাটতির কারণে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা হতাশ হন।

তিনি বলেন, আমরা সবুজ ও গ্রামীণ পর্যটন অফার করি, কিন্তু সরকারি সহায়তা না পেলে তা সম্প্রসারণে আমরা পিছিয়ে পড়ি।

আরাল সি লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান এম. নাসির উদ্দিন বাদল বলেন, আমরা দাকোপ উপজেলায় ‘সুন্দরী ইকো রিসোর্ট’ তৈরি করেছি, যেখানে পর্যটকরা নৌকায় করে সুন্দরবনের খাঁড়ি ঘুরে দেখতে পারেন। ইকোট্যুরিজম দ্রুত বাড়ছে, কিন্তু সরকারকে এর সুবিধার্থে উদ্যোগ নিতে হবে।

কিছু ট্যুর অপারেটর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন পর্যটন খাতের সংস্কারকে তাদের নীতিগত উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ হাবিব আলী বলেন, আমাদের সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু দেশের ভাবমূর্তি ও সরকারিভাবে সহযোগিতার অভাব আমাদের পিছিয়ে রাখে।

বিগত বছরগুলোতে একাধিক পর্যটন মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হলেও তা বাস্তবায়নে গতি কম ছিল এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টেকসইতা বা স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা গুরুত্ব পায়নি।

বাংলাদেশ রিসোর্ট অ্যাসোসিয়েশন সতর্ক করে বলেছে, যথাযথ জোনিং, মান নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন গন্তব্যে বিনিয়োগের অভাবে একদিকে প্রচলিত পর্যটন কেন্দ্রগুলো অতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অন্যদিকে সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ অনেক অঞ্চল অবহেলিতই থেকে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে এখন জরুরিভাবে একটি জাতীয় পর্যটন কৌশল দরকার—যেখানে পরিবেশ সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার মধ্যে সমন্বয় থাকবে। এই মডেল একদিকে জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোর চাপ কমাবে, অন্যদিকে পর্যটকদের আরও অর্থবহ ও প্রকৃত অভিজ্ঞতা দেবে।

Share this news