Published :
Updated :
মরুভূমি পৃথিবীর মানুষের কাছে বরাবরই একটি কৌতূহলের নাম। কেউ মনে করেন এটি সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ, আবার কারও মতে এটি প্রকৃতির একটি ভিন্ন মাত্রার সৌন্দর্য। তবে একবার ভেবে দেখুন, আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগে এসব মুরুভূমি কেমন ছিল! তখনও কি এসব বিস্ময়কর জায়গাগুলো জনমানবহীন রূক্ষ্ম ভূমি ছিল নাকি ছিল সবুজের সমারোহে পরিপূর্ণ?
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, পৃথিবীর অনেক মরুভূমিই একসময় আজকের এই অবস্থায় ছিল না। বরং জলের ধারায় বহমান থাকতো সেখানকার ভূমি। আর জল মানেই সেখানে থাকবে প্রাণের স্পন্দন। আর তাই তো জলধারায় তৃপ্ত হয়ে সেখানে বিস্তার লাভ করেছিল সবুজ বনাঞ্চল। আর তেমনই এক মরুভূমির নাম আরব মরুভূমি।
আরব উপদ্বীপ বা আরব মরুভূমি প্রায় ২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এই মরুভূমিতে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু ধূসর বালির সমাহার। কোথাও নেই সবুজের ছিঁটেফোঁটামাত্র। মাঝে মাঝে কয়েকটি উষ্ণতাসহিষ্ণু মরু উদ্ভিদ দেখা গেলেও তা খুবই নগণ্য।
অত্যধিক উষ্ণ তাপমাত্রার কারণে সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করা অনেকটাই অসম্ভব। অথচ আপনি জানলে অবাক হবেন সেখানে এমন কিছু নজির পাওয়া গেছে যার মাধ্যমে ভূতাত্ত্বিকরা অনেকটা দ্বিধাহীনভাবেই বলছেন একসময় সেখানে সবুজ বনাঞ্চল ছিল। এছাড়া ছিল প্রাকৃতিক জলধারার প্রবাহমানতা। আর এসব যুক্তির নেপথ্যে তাদের হাতে রয়েছে বেশ কিছু প্রমাণ।
আমরা জানি, আরব উপদ্বীপ খনিজ তেলের একটি বিশাল ভান্ডার। তবে এই তেল আপনা-আপনি তৈরি হয় নাই। একটি জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই তেল উৎপন্ন হয়েছে।
মৃত মাইক্রোস্কোপিক উদ্ভিদ এবং কিছু প্রাণীর মৃত দেহাবশেষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পানির নিচে পড়ে থাকার পর অক্সিজেনের অভাবে মৃত অণুজীবগুলো হাইড্রোকার্বনে পরিণত হয়।
আর এর মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ব্যারেল তেলের মজুদ তৈরি হয় সেখানে যা আজকের দিনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে তেল সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। আর এর মাধ্যমে এটি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, একসময় আরব মরুভূমি জল, বনায়ন এবং জীব বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছিল।
ইতিহাসবিদদের মতে, আজ থেকে প্রায় ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নীলনদের উপত্যকায় যেসব মানুষ বাস করতো তাদের অনেকে একসময় বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে এশিয়া অঞ্চলে চলে আসে। যেহেতু আরব মরুভূমি সেসময় সবুজে পরিপূর্ণ ছিল, তাই তাদের অনেকে বসবাসের জন্য এই এলাকাটিকে বেছে নেয়।
সেসময় আরব মরুভূমির নদীবাহিত জায়গাগুলো ছিল তাদের বসবাসের জন্য সবচেয়ে অনুকূল। তাই সেসব এলাকাতেই তারা বসবাস শুরু করে। তাদের বিভিন্ন শিল্পকর্ম, পাথরের হাতিয়ার, এবং বসতবাড়ির অবশিষ্টাংশ ইতিহাসবিদদের এই বার্তাই দেয়।
এছাড়া সৌদি আরবের একটি প্রত্নতত্ত্ব সম্মেলনে সেটির আয়োজক সৌদি কনভেনশন ফর ট্যুরিজম অ্যান্ড এন্টিকুইটিস ন্যাশনাল হেরিটেজের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড. আলী আল গাব্বান আরব মরুভূমি একসময় সবুজের সমারোহে পরিপূর্ণ থাকার কথা বলেন।
সৌদি আরবের উত্তর অংশের তাইমা প্রদেশে একটি শুকনো হ্রদের তলদেশে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বছর আগের একটি হাতির দাঁত পাওয়া গেছে। এছাড়া সেখানে কুমির ও সামুদ্রিক ঘোড়ার জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছেন ভূতাত্ত্বিকরা। আর এসব প্রাণী কখনোই পানি ছাড়া এমন শুষ্ক জলবায়ুতে বেঁচে থাকতে পারে না।
অন্যদিকে আরব মরুভূমিজুড়ে গবেষকরা প্রায় ১০ হাজার প্রাচীন হ্রদ এবং নদীর আলামত খুঁজে পেয়েছেন। এছাড়া সেখানে ৯০ হাজার বছরের পুরোনো মানুষের হাড় পাওয়া গেছে যা মূলত একসময় আরব মরুভূমিতে জনবসতির একটি প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
বিশ্ববিখ্যাত নেচার জার্নালে আরব উপদ্বীপকে আফ্রিকা এবং ইউরেশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে দেখানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষকদের তথ্যমতে, সেখানে জলহস্তীর জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। যেহেতু জলহস্তী পানি এবং সবুজ বনাঞ্চল ছাড়া বাঁচতে পারে না, তাই এটিকেও গবেষকরা আরব উপদ্বীপকে একসময় প্রাণসঞ্চালনের উজ্জ্বল নজির হিসেবে দেখছেন।
এছাড়া ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং সৌদি কমিশন ফর ট্যুরিজম অ্যান্ড ন্যাশনাল হেরিটেজের যৌথ সহযোগিতায় প্যালিওডেজার্টস প্রজেক্টের গবেষকরা আরব মরুভূমিতে চিত্রকর্মের খোঁজ পেয়েছেন। সেখানকার ২৫৪ টি পাথরে তারা এমন চিত্রকর্মের খোঁজ পান যেখানে পশুপাখির ছবিও ছিল। আর এটি সেখানে একসময় মানুষের বসবাসের ইঙ্গিত বহন করে যার মাধ্যমে গবেষকরা ধরে নিয়েছেন আরব মরুভূমিতে একসময় পানি ও সবুজের সমারোহ ছিল। কারণ তা না হলে এমন চরমভাবাপন্ন পরিবেশে মানুষের টিকে থাকা রীতিমতো অসম্ভব।