Published :
Updated :
শিক্ষার্থী মানেই যেন প্রতিদিন নিয়ম করে ক্লাস করা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই খাতা নিয়ে বসে থাকা, পাঠ্যবইয়ের পড়া মনে রাখার অক্লান্ত পরিশ্রম। কিন্তু এভাবে কতদিন কারই বা ভালোলাগে?
সহজেই চলে আসে পড়ালেখার প্রতি বিতৃষ্ণা, ছাত্রজীবন হয়ে যায় এক ঘেয়ে। কিন্তু আদতে ছাত্রজীবনই হয়ে ওঠে সবচেয়ে আনন্দের, যখন পাঠ্যসূচির বাইরে সহশিক্ষার সাথে পরিচয় হয় একজন শিক্ষার্থীর।
অনেকের ভয় বা ভ্রান্ত ধারণা যে সহশিক্ষা মূলশিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যহত করবে কিনা। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত পড়ালেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকও শিক্ষাকে আরো মজবুত করে, ফলাফল ও কর্মসংস্থান উভয়ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সহশিক্ষাকার্যক্রম হলো পাঠ্য বইয়ের বাইরে নিজের পছন্দের অন্য কোনো বিষয় চর্চা করা অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে বা বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একজন শিক্ষার্থী যেসব শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে।
সহশিক্ষাকার্যক্রমগুলোও একেকটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। একজন শিক্ষার্থী এইসব করমকান্ডগুলোর মধ্যদিয়ে নিজেকে পড়ালেখার পাশাপাশি বিশেষ কিছু বিষয়ে দক্ষ করে তোলে।
সামাজিক দক্ষতা
অধিকাংশ সহশিক্ষা বা এক্সট্রাকারিকুলার বিষয়গুলো দলগত কাজ করতে শেখায়। অন্যদের সাথে মিলেমিশে কাজ করার, যোগাযোগ করার এবং সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। সহযোগিতা, নেতৃত্ব, এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে সহশিক্ষা। শিক্ষার্থীরা বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করতে ও অন্যদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে শিখে, ফলে তাঁদের মধ্যে সহনশীলতা বিকশিত হয়।
আত্মবিশ্বাস
সহশিক্ষাকার্যক্রম চর্চার ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা উপলব্ধ করে। বিভিন্ন আয়োজনে দক্ষতা এবং প্রতিভা প্রদর্শন করার মধ্যদিয়ে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে।
সৃজনশীলতা
নতুন বিষয় শেখার মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীল চিন্তা ভাবনার বিকাশ ঘটে। এটি তাদের বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করে যা তাদের ভবিষ্যতের কর্মজীবনে উপযোগী করে তোলে।
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধি
অনেক সহশিক্ষাকার্যক্রম শারীরিকভাবে সক্রিয় ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তুলতে সহযোগিতা করে। এছাড়া মোটামুটি সকল কার্যক্রমগুলোই শিক্ষার্থীরা নিজের আনন্দে চর্চা করে, ফলে তাদের মানসিকচাপ দূর হয়।
শৃঙ্খলা
খেলাধুলা, বিতর্ক, সংগীত নৃত্য ও নাটক কিংবা আবৃত্তি, চিত্রাংকন, কারুশিল্প ইত্যাদি সকল ধরনের কাজেই কিছু নিয়ম মেনে চর্চা করতে হয় যা শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে প্রশিক্ষিত করে। সময়মত পড়ালেখার বিষয়গুলো শেষ করা, পাশাপাশি সহশিক্ষা চর্চা তাদেরকে সময়-সচেতন ও কাজের ব্যবস্থাপনা করতে শেখায়।
কর্মসংস্থানের সুযোগ ও নেটওয়ার্ক তৈরি
সহশিক্ষাকার্যক্রম শিক্ষার্থীদের নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা করার এবং তাদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক তৈরি করার সুযোগ করে দেয়। এটি তাদের ভবিষ্যতের কর্মজীবনের জন্য সম্ভাব্য সুযোগ খুঁজে পেতে সহায়তে করে।
খেলাধুলা
শিক্ষা জীবনে শরীরচর্চা, খেলাধুলা ও সর্বোপরি কায়িকশ্রম শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু শারীরিক সক্ষমতা নয়, লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধুলার মধ্যদিয়ে সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাচর্চা, দায়িত্ববোধ, নেতৃত্বের গুণাবলিসহ নানা ধরনের গুণাবলির সঞ্চার ও চর্চা করতে শেখায়।
বিতর্ক ও বক্তৃতা
বিতর্ক ও বক্তৃতা শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ দক্ষতা, সমালোচনা ও বিশ্লেষণমূলক চিন্তাভাবনা বিকাশে বেশ সহায়ক। যুক্তিবাদী ও স্বচ্ছ মানসিকতা নিয়ে চিন্তাভাবনা ভিন্ন দৃষ্ট্রভঙ্গিকে সহজে মেনে নিতে শেখায়, সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা জানতে পারে।
সঙ্গীত, নৃত্যওনাট্য
সঙ্গীত, নৃত্য ও নাট্যচর্চা ছাত্রছাত্রীদের তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে ও আত্মবিশ্বাসী হতে শেখায়। যাদের মঞ্চভীতি আছে তারা তা কাটিয়ে সবার সামনে সাবলীলভাবে নিজেকে উপস্থাপন করার সাহস পাবে এসব সহশিক্ষাকার্জক্রমগুলোর মাধ্যমে।
লেখা-লেখি
অনেক শিক্ষার্থীই নিজের জটিল চিন্তাগুলো স্বরচিত আকারে সাজিয়ে লিখতে চায়। সেক্ষেত্রে মনের খোরাক মেটাতে মাসিক, ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক ম্যাগাজিন বা পত্রিকাগুলোতে কিংবা অনলাইনে ব্লগে, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গল্প, কবিতা, কিংবা গদ্যাকার রচনা লিখতে পারে।
এই লেখালেখির অভ্যাস প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা দক্ষতা দেয় যা কর্মজীবনে কাজে লাগে।
কুইজ ক্লাব
সাধারণ জ্ঞান বা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ভালো দখল থাকলে ছাত্রছাত্রীরা যুক্ত হতে পারে কুইজ ক্লাবে। আজকাল অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আলাদা কুইজ ক্লাব আছে। এরা নিয়মিত কুইজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে, যা শিক্ষার্থীদের মেধাকে আরো শক্তিশালী করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
ল্যাংগুয়েজ ক্লাব
বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইংলিশ ক্লাব, লিটারেচার ক্লাব, ল্যাংগুয়েজ ক্লাব তৈরি হচ্ছে, যা সাহিত্য চর্চা ও কর্মজীবনের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র কেননা, বর্তমানে নিজ মাতৃভাষার পাশাপাশি বিদেশী ভাষা জানাও দক্ষতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
বিজ্ঞান ক্লাব
বিজ্ঞানমনস্কদের উৎসাহে সম্প্রতি বিভিন্ন স্কুল-কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, নিয়মিত কর্মকাণ্ড, লেখালেখি, বিজ্ঞান মেলা, প্রজেক্ট শোকেস, গবেষণা প্রতিযোগিতা, কনফারেন্স ইত্যাদি উপায়ে পাঠ্য বইয়ে পড়া বিজ্ঞানের জটিল জিনিসগুলোর বাস্তবমুখী উপস্থাপনের চেষ্টা করছে ক্লাবগুলো।
এছাড়াও ক্যারিয়ার, ভ্রমণ, চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করে বিভিন্ন সংগঠন। পাশাপাশি রয়েছে সমাজসেবামূলক বিভিন্ন সংগঠন যারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে, কিংবা আর্থসামাজিক কোনো সংকটে নিজেদের নাগরিকদায়িত্ব পালনে কর্মরত।
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাজীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি করার মতো সহশিক্ষাকার্যক্রমের কমতি নেই। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, আগ্রহ এবং দায়িত্ববোধের। তবে অনেকেই ছাত্রজীবনের সময়টুকু লেখাপড়া নিয়ে এতো বেশি চিন্তিত থাকে যে, সময় সুযোগ বের করে কিছু সহশিক্ষাকার্যক্রমে জড়িয়ে পড়া তাদের জন্য ভীতিকর কিংবা অপ্রয়জনীয় মনে হয়।
আবার কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব কার্যক্রমে এতো বেশি সময় দিয়ে যে বাসায় গিয়ে ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারে না। কিন্তু এর কোনটিই কাম্য নয়, দুটই বর্জনীয়। বরং পড়ালেখার লক্ষ্য ঠিক রেখে, ভারসাম্য বজায় রেখে সঠিক সময় ও রুটিন মেনেসহ শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াই উত্তম।