Published :
Updated :
পাবনার নগরবাড়ি অঞ্চলে প্রচলিত আঞ্চলিক একটি শব্দ 'সিনপাট।' এর মানে 'সিন ক্রিয়েট' করা। সবকিছু ঠিকঠাক চলতে চলতে হঠাৎ দেখা গেল হয়ে গেছে গুবলেট। কারো ভুলে কিংবা অসাবধানতায় ভণ্ডুল হয়ে গেছে কাজটা। একেই বলে 'সিনপাট।'
এই শিরোনামে গত ১১ জানুয়ারি ওয়েব প্ল্যাটফর্ম 'চরকি'-তে মুক্তি পেয়েছে মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম পরিচালিত ওয়েব সিরিজ 'সিনপাট।'
বছর দুয়েক আগে রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত 'শাটিকাপ' ওয়েব সিরিজটি মুক্তি পেয়েছিলো। সেটি ব্যাপক সমালোচক আনুকূল্য ও জনপ্রিয়তা পায়।
এর ধারাবাহিকতায় আবারো রাজশাহীর স্থানীয় ভাষা ও স্থানকে আমরা দেখতে পেলাম 'সিনপাট'-এও। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজবাড়ি ও পাবনার স্থানীয় ভাষা ও স্থানও।
"সোহেল একজন নিম্নশ্রেণির অপরাধী। সে মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। নিজের এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে সে ফাজুকে সঙ্গে নিয়ে নতুন এক শহরে আস্তানা গাড়ে। এখানে এসেও অপরাধ তাদের পিছু ছাড়ে না৷ সঙ্গে যুক্ত হয় এলাকার নেশাদ্রব্য বিক্রেতা দুরু। এদিকে চালাক সাংবাদিক হাবিবুল বাশার তাদের পূর্বের অপরাধের সন্ধান করে এসে পৌঁছায় এখানেও৷ সবদিক থেকে শুরু হয় 'সিনপাট'।"
ওয়েব সিরিজটির গল্প সম্পর্কে এ ভাবেই বলছে চরকি। সাতটি পর্বে সর্বমোট ১৬৩ মিনিটের এই সিরিজটি নির্মিত হয়েছে। পর্বগুলোর নাম যথাক্রমে 'অতিরিক্ত এক্সেস', 'পেলান্টিক', 'ফিটিং শপ', 'ট্যাংসন', 'হাজর্যা', 'আবগারি' ও 'অজাল।'
বিভিন্ন দৃশ্যে জিন্নাত আরা (বামে), সোহেল শেখ (ডানে-উপরে) ও মোহাম্মদ রিফাত বিন মানিক
গল্পটির মূল বিষয় মাদক ব্যবসা ও মাদক চোরাচালান। ফজু ছিলো একজন বাসের হেল্পার। এলাকা থেকে বিতাড়িত সোহেলের সংস্পর্শে এসে সে জড়িয়ে যায় এই পথের সঙ্গে। এদিকে প্রচণ্ড কৌশলী সাংবাদিক হাবিবুল বাশারের নজরে আসে এসব কর্মকাণ্ড। এদের পেছনে লেগে গিয়ে তদন্ত শুরু করেন তিনি।
গল্পে নতুন বাঁক নিয়ে আসে নেশাদ্রব্য বিক্রেতা দুরুর আগমন। ফজুর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে সোহেলের হয়ে 'ইনফর্মার' এর দায়িত্ব পায় দুরু। এদিকে হাবিবুল বাশারের সতর্ক চোখকে কিছুই ফাঁকি দিতে পারে না। সবমিলিয়ে দারুণ জমে ওঠে 'সিনপাট।'
সিরিজটির শুরুতেই জানিয়ে দেওয়া হয় এটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্মিত। তাই গালি-গালাজ কিংবা রুক্ষ ভাষা নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই। কাহিনীতে যৌনতার তেমন স্থান নেই। শুরুতে সতর্কীকরণ বার্তা দেওয়ার ফলে দর্শক কী দেখতে চলেছেন, সে বিষয়ে পূর্বধারণা পাবেন।
যারা শাটিকাপ দেখেছেন তাদের নার্কো থ্রিলার সম্পর্কে অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ তবে সেটি দেখা না থাকলেও এর কাহিনী বুঝতে কোথাও সমস্যা হবে না।
সিরিজটির শুরু থেকেই দর্শকের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে নানারকম অপরাধ কার্যক্রমে অপরাধীদের জড়িয়ে যাওয়া। দলের ভেতরের সদস্যদের ভেতর অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব তাদের সংঘাতের পথে নিয়ে যায়।
আমরা দেখি, সোহেল ( সোহেল শেখ) ফজুকে সাথে নিয়ে আলাদাভাবে আবারো মাদক দ্রব্যের চোরাচালানের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এর ভেতর ছোট ছোট আনন্দের উপলক্ষও দেখা যায়। যেমন- বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে আর্জেন্টিনার জয়লাভ সোহেলকে আনন্দিত করে। পছন্দের মেয়ের সঙ্গে কল্পনায় নিজের বিয়ে হতে দেখে সে।
আবার, বাসের হেল্পার থেকে মাদকের এই জগতে আসা ফজুকে মাঝে মাঝে জীবন সম্পর্কে অনিশ্চিত ও সংশয়ী হতে দেখা যায়। ফজু (মোহাম্মদ রিফাত বিন মানিক) কিছুতেই জেল খাটতে পারবেনা বলে সোহেলকে জানায়। পুলিশি অভিযান ও অন্যান্য প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গ্রেফতারের সম্ভাবনা ফজুকে দুর্বল করে তোলে। ফলে সোহেলের পা ধরে তাকে কান্নাকাটি করতেও দেখি আমরা।
কাহিনীটিতে বাঁক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো সাংবাদিক হাবিবুল বাশারের (শিবলী নোমান) উপস্থিতি৷ বাশারের চরিত্রটি ডালে ডালে চলা সোহেল ও ফজুর সঙ্গে পাতায় পাতায় চলতে থাকে। ফলে তাদের জন্য মাদক ব্যবসা কঠিনতর হয়ে ওঠে।
সোহেল-ফজুর অপরাধকার্যে 'ইনফরমার' হিসেবে যোগ দেয় দুরু (জিন্নাত আরা)। তার চরিত্রটি অভাবী বস্তিবাসী এক নারীকে তুলে ধরেছে, যার স্বামী রয়েছে জেলে, বকেয়া রয়েছে দুই মাসের বাড়িভাড়া, পেটের দায়ে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে। দুরুর চরিত্রটির মাধ্যমে পৈতৃক জমিজমা থেকে নারীদের বঞ্চিত হবার ব্যাপারটিও উঠে এসেছে গল্পে।
সাতটি পর্বে ক্রমাগত অপরাধ, তদন্ত, ঝুঁকির প্রকাশ ঘটেছে। ফজু (মোহাম্মদ রিফাত বিন মানিক), সোহেল (সোহেল শেখ) ও দুরু (জিন্নাত আরা) নিজ নিজ চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। এর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন সাংবাদিক হাবিবুল বাশার (শিবলী নোমান)।
সিরিজের চিত্রনাট্য ও পরিচালনা বেশ নিখুঁত৷ সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার। কালার গ্রেডিং দারুণ। মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হওয়া গানগুলো শ্রুতিমধুর। আবহসঙ্গীতও মুগ্ধ করার মতো।
সিরিজটির নামের সার্থকতা মিলতে শুরু করে ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই৷ সিনপাট তথা পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটে একেকজনের সঙ্গে একেক দিক থেকে।
পৈতৃক সম্পত্তি বঞ্চিত দুরু রোমাঞ্চকর এক পরিকল্পনা করে। আবার, সোহেলের আশ্বস্ত করা কথায় তার সঙ্গে থেকে যায় বারবার এই ব্যবসা ছেড়ে বাসে ফিরে যেতে চাওয়া ফজু। দুরুর ছেলেকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে হাবিবুল বাশার৷ নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ উদ্ধার হওয়া ও ছেলেকে ফিরে পাওয়া- দুটো ব্যাপারই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় দুই নৌকায় পা রাখতে হয় দুরুকে। দুরুর পরিকল্পনামতো কাজ করতে গিয়ে সোহেল, ফজু দুঃসাহস করে বসে। ফজু এমন অমোচনীয় পাপের সঙ্গে জড়িয়ে যায় যা তার ফেরার পথ বন্ধ করে দেয় চিরতরে।
সবমিলিয়ে গল্পটি স্পষ্টভাবে কোনো সমাধান আনেনা। এমন একটি জায়গায় গিয়ে গল্পটি শেষ হয় যাতে করে মনে হবে সব পক্ষই জিততে পারে বা কার্যসিদ্ধি করতে পারে, আবার এমনও হতে পারে প্রত্যেকেরই নিজস্ব উদ্দেশ্য ভণ্ডুল হবে; আর এখানেই 'সিনপাট' নামের সার্থকতা।
mahmudnewaz939@gmail.com