Bangla
a year ago

স্মৃতির পাতায় হারানো আর্মেনিয় সম্প্রদায় ও আর্মেনিয়ান চার্চ

Published :

Updated :

পুরান ঢাকাকে বিশ্লেষণ করে বলা যায়বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলিনামে। অগণিত গলিঘুপচি, বাজার থাকায় এই নামকরণ করেছিল কেউ হয়তো। শুধু বাজার নয়, এখানে আছেপুর’, ‘গঞ্জ’, ‘তলা’, ‘তলী’ ইত্যাদির সমন্বয়ে বাহারি নামের অনেক রাস্তাও।  ৪০০ বছরের ইতিহাসের খনি এই পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো যেন একেকটা ইতিহাসের সাক্ষী।

তেমনি এক রাস্তায়, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন মিডফোর্ট রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে প্রাচীন সুবিশাল, রাজকীয় ফটক, যার পাশে লেখা 'আর্মেনিয়ান চার্চ, ১৭৮১'। জ্বী হ্যা, এটি সেই কয়েক শতাব্দী পুরোনো ঐতিহাসিক আর্মেনিয়ান চার্চ। জায়গাটি আর্মানিটোলার 'চার্চ রোড' নামেও পরিচিত। 

ষোলো শতকে পারস্যের সাফাভি শাসকগণ মধ্য এশিয়ার আর্মেনিয়া জয়ের পর আর্মেনিয়রা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শাহ আববাস রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ইস্পাহান ও নিউজালফায় আন্তঃএশীয় বাণিজ্যে দক্ষ প্রায় চল্লিশ হাজার বণিককে পুনর্বাসিত করেন। 

এ দুটি বাণিজ্য-নগরী থেকেই আর্মেনীয়রা পারস্যদেশীয় ভাগ্যান্বেষীদের অনুসরণ করে প্রথম বাংলায় আসেন। প্রথমদিকে তারা তাদের পারস্যদেশীয় মনিবদের পক্ষে বাংলায় ব্যবসা করতেন এবং কালক্রমে তারা বাংলায় তাদের নিজস্ব সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।

আর্মেনিয়রা ঢাকায় যে অঞ্চলে বসবাস করতেন, কালক্রমে তার নাম হয়ে যায় আরমানিটোলা। মুসলিম শাসনামলে কিন্তু এই এলাকার নাম ছিল 'আলে আবু সাঈদ'। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঢাকা শহরে ৪০টির মতো আর্মেনিয় পরিবার ছিল। আর্মানিটোলায় বসতি স্থাপনের পর তারা এখানে তাদের গির্জা নির্মাণ করেন।

ধর্মবিশ্বাসে আর্মেনিয়রা ছিলেন গ্রিক বা অর্থডক্স চার্চের অনুসারী খ্রিস্টান। যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আর্মেনিয় বসতি স্থাপন করেছেন, সেখানেই তারা গির্জা নির্মাণ করেছেন। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি হলে আর্মেনিয়রা ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চে প্রার্থনা সভা হতো। এরপরে আর কোনো আর্মেনিয় ফাদার বা যাজক ঢাকায় না থাকায়  নিয়মিত প্রার্থনা বন্ধ হয়ে যায়। 

পুরনো ঢাকার আর্মানিটোলায় রয়েছে আর্মেনিয়দের উপাসনালয় ‘আর্মেনিয়ান চার্চ (Armenian Church)। এটি 'চার্চ অভ হোলি রিজারেকশন' নামেও পরিচিত। এটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৮১ সালে, ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনিয়দের দ্বারা। 

প্রথম দিকে ঢাকায় আগত আর্মেনিয়দের কবরসমূহ তেজগাঁওয়ের ফার্মগেট গির্জা প্রাঙ্গনে পাওয়া যায়। ঐ সময় আর্মেনিয়রা আরমানিটোলায় একটি ছোট গির্জায় প্রার্থনা করত (এ ধরনের ছোট গির্জাকে বলে চ্যাপেল)। 

১৭৮১ সালে বিত্তবান আর্মে্নিয় জমিদার নিকোলাস পোগজ (স্থানীয় মানুষের কাছে যিনি নিকি সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন) ঐ চ্যাপেলের স্থলে বেশ কয়েক বিঘা জমির উপর বিশাল গির্জা নির্মাণ করেন। তিনি গির্জার নামকরণ করেন ‘চার্চ অব দ্য রিজারেকশন’।

বর্তমানে যেখানে চার্চটি অবস্থিত, সেটি ছিল একটি কবরস্থান। সে কারণেই এখনও চার্চের বারান্দায় কিছু কবরফলক দেখা যায়। গির্জা তৈরীর জন্য ‘আগা মিনাস ক্যাটচিক’ নামের ভদ্রলোক জমি দান করেছিলেন। এছাড়াও লোকমতে গির্জা নির্মাণে আরো চার ব্যক্তি সাহায্য করেছিলেন। তারা হলেন মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ, আগা এমনিয়াস এবং মার্কার পোগজ। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে গির্জার ঘড়িঘরটি ভেঙ্গে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে তা সংষ্কার করা হয়। 

গির্জায় রয়েছে চারটি দরজা ও ২৭টি জানালা। আর্চ সহ কলামের সারি রয়েছে চারদিকে। গির্জা ভবনের শেষ মাথায় আছে একটি ষড়ভূজ আকৃতির টাওয়ার। সমগ্র গির্জাটি সাদা রং করা, কলাম-রেলিং ইত্যাদির ধারগুলোতে হলুদ রং দিয়ে নকশা করা আছে।

চমৎকার কারুকাজ করা গির্জাফটক পেরিয়ে প্রাঙ্গনে ঢুকলেই হাতের বামে গির্জাটি দাঁড়িয়ে। তবে ঢুকে প্রথমেই নজর কাড়বে  গির্জার চারপাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কবর। প্রত্যেকটি কবরফলকে মৃত ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু এবং কিছু স্মৃতিচারণমূলক কথা লেখা আছে।

অন্য সব কবরের থেকে একটি বেশ আকর্ষণীয়। কবরটি জনৈক ক্যাটচিক আভেটিক থমাসের, যিনি ১৮৭৭ সালে প্রয়াত হয়েছেন। কবরের এপিটাফে লেখা আছে-

A fond wife’s tribute

To her deeply mourned

And best of husband.

এই একটিমাত্র কবরের উপরেই আছে একটি ‘ওবেলিস্ক। কবরের উপরে বেদির মতো দেখতে স্তম্ভকে ওবেলিস্ক বলা হয়। ওবেলিস্কের উপরে রয়েছে মাদার মেরীর একটি চমৎকার মার্বেল পাথরে তৈরী ভাষ্কর্য, ভাষ্কর্যটির একটি হাত দুর্ঘটনাবশত ভেঙ্গে গিয়েছে। মূর্তিটি থমাসের স্ত্রী এনেছিলেন কলকাতা থেকে।

পুরো গির্জা প্রাঙ্গন জুড়ে ছড়ানো কবরগুলোর এপিটাফ পড়তে পড়তে ফিরে যাওয়া যায় সেই প্রাচীন সময়ে। আর্মেনিয় আর ইংরেজি ভাষা মেশানো এপিটাফগুলোতে কাব্যিক ভাষায় স্বজনদের আবেগ প্রকাশ পায়, সেই সাথে অধিকাংশ এপিটাফে ধর্মগ্রন্থের বাণীও উদ্ধৃত রয়েছে। 

এপিটাফগুলো তৈরীতে শ্বেতপাথর, বেলেপাথর ও কষ্টি পাথরের ব্যবহার করা হয়েছে। পাথরগুলো কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে আনা। কবরগুলোর মাঝে একটি ছোট বেদির উপর একটি সূর্য ঘড়ি আছে।

চার্চ প্রাঙ্গনের শেষ মাথায় একটি লাল ইটের প্রাচীন বাড়িতে চার্চেরওয়ার্ডেনবা তত্ত্বাবধায়ক থাকতেন। মাইকেল জোসেফ মার্টিন এই চার্চের সর্বশেষ ওয়ার্ডেন, ২০০৫ সালে স্ত্রীর মৃত্যু হলে কানাডায় নিজ মেয়েদের কাছে পাড়ি জমালে ঢাকা চূড়ান্তভাবে আর্মেনীয়শূন্য হয়ে যায়। 

২০২০ সালের ১১ এপ্রিলে মাইকেল জোসেফ মার্টিন (সর্বশেষ বাংলাদেশি আর্মেনিয়) বার্ধক্যজনিত কারণে ৮৯ বছর বয়সে মারা যান। মার্টিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আর্মেনীয়দের যবনিকা ঘটে।

[email protected]

Share this news