Published :
Updated :
আজ থেকে ১৬ বছর আগের এই তারিখটিতেই এক হেমন্ত রাতে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন সঞ্জীব চৌধুরী। পেশায় সাংবাদিক, ফিচার সাংবাদিকতার মহীরুহ সঞ্জীব সুনাম কুড়িয়েছিলেন কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও। প্রচলিত বা প্রথাগত সঙ্গীতের বাইরে গানের কথায় ভিন্নতা এনে হাজির হয়েছিলো তার ব্যান্ড 'দলছুট।'
মূলধারা থেকে আলাদা হলেও সঞ্জীব ও তার দলছুট শ্রোতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি। জনশূণ্য 'বিরান' পথে একা একা হেঁটে বেড়ানোর কথা সঞ্জীব বলেছেন তার গানে। আর কেউ না জানুক, ভুল দরজায় কড়া নেড়ে যাওয়ার সেই খতিয়ান জানে 'কান্নার রং ও জোছনার ছায়া।'
সঞ্জীব শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন কৃতি। কিন্তু প্রচলিত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার পথে হাঁটেননি। প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাই বাজার বা বাণিজ্য নয়, তার গানের মূল উদ্দেশ্য ছিলো গণমানুষ ও তাদের জীবন।
'আন্তর্জাতিক ভিক্ষা সংগীত' কিংবা 'চল বু বাইজান' এর মতো গানগুলো খেয়াল করা যাক।
'আমি অন্ধ ফকির বাবা, চোখে দেখিনা হাবাগোবা/ ভাঙ্গা লাডি, ফুডা থালা/ হাতে হারিকেন, পিঠে ঝোলা' (আন্তর্জাতিক ভিক্ষা সংগীত) কিংবা 'চল বু প, মাডি কাডাম / চাইয়া রইলি কার পানে/ রাস্তার মাজে কাডবো মাডি/ অডার দিছে চেরম্যানে।' (চল বু বাইজান)
সঞ্জীবের গানের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় তার গানের চরিত্র শ্রমজীবী মানুষেরা। এর বাইরে জীবনসম্পর্কিত নানান বিষয় তার গানে এসেছে নিয়মিতভাবে।
'আকাশ জুড়ে শঙ্খচিলের শরীরভেজা কান্না থামাও/ সমুদ্র কি তোমার ছেলে, আদর দিয়ে চোখে মাখাও' (সমুদ্রসন্তান) - কথাগুলোকে বহুমাত্রিকভাবে দেখা যায়। এই শাশ্বত অনুভবকে নির্দিষ্ট এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা যায়না।
আবার প্রেমের ক্ষেত্রেও সঞ্জীব উচ্ছ্বল। তার সতেজ হৃদয় বলছে-' আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ/ আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল চাঁদ।'
এই প্রেমের তীব্রতার মতোই তীব্র ছিলো তার দ্রোহ। 'রাশপ্রিন্ট' নামে তার প্রকাশিত ম্যাগাজিনটিতে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র মোড়কে ঢেকে দেওয়া নিয়ে লিখেছিলেন, ' লেফটেন্যান্ট জেনারেলের ট্রাকের চাকার নিচে ফেটে যাওয়া দিপালী সাহার হৃৎপিন্ডকে যারা ভ্যালেন্টাইন বেলুন বানিয়ে বেচে দ্যায়, অথবা যাদের শুধুমাত্র শরৎবাবুই কাঁদাতে পারেন, একমাত্র গোপাল ভাঁড়ই হাসাতে পারে- সেই নিথর স্বাভাবিকতায় মৃত মানুষদের ব্যবচ্ছেদ ঘটে এক নীল ক্লিনিকে।'
সঞ্জীবের এই প্রত্যয় তার সাহিত্যে যেমন আছে, তেমন আছে তার গানেও। 'আগুনের কথা বন্ধুকে বলি, দু হাতে আগুন তারও/ কার মালা হতে খসে পড়া ফুল রক্তের চেয়ে গাঢ় / যার হাতখানি পুড়ে গেলো বধূ আঁচলে তাহারে ঢাকো/ আজও ডানা ভাঙা একটি শালিক হৃদয়ের দাবি রাখো।' (হৃদয়ের দাবি)।
কবি কামরুজ্জামান কামুর সঙ্গে যৌথভাবে লেখা এই গানে প্রতীক ও চিত্রকল্প ব্যবহার করে দ্রোহের আগুনই জ্বালতে চেয়েছেন সঞ্জীব।
প্রেম ও দ্রোহ সমানুপাতিকভাবে উপস্থিত হয়েছে তার গানে। কামরুজ্জামান কামুর লেখা 'বায়োস্কোপ' এর সেই লাইন- 'ডাইনে তোমার চাচার বাড়ি, বাঁয়ের দিকে পুকুরঘাট/ সেই ভাবনায় বয়স আমার বাড়ে না' কিংবা 'অন্তরে থাক পদ্মগোলাপ,গদ্যে -পদ্যে আঁকছি মুখ/ ঘুরতেছিলাম রঙের মেলায়, অপূর্ব সেই তোমার চোখ / অমন পলক ফেলতে তো কেউ পারেনা'- কথাগুলো কিশোর ও তরুণদের উচ্ছ্বল প্রেমের রঙিন দিনের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
আবার, সেই প্রেমও তার গানে বৈচিত্রময় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছে। 'এই নষ্ট শহরে' গানে 'নাম না জানা এক মাস্তান' এর কথা বলেছেন সঞ্জীব। মানুষ সাদা-কালো নয়, সম্পূর্ণ খারাপ বা সম্পূর্ণ ভালো নয়৷ আপাতভাবে খারাপ এক মাস্তানেরও থাকতে পারে প্রেমিক হৃদয়। সেই ব্যাপারটি উঠে এসেছে এভাবে- ' আজ স্বীকার করে বলো/ তুমি তাকে মিথ্যে বলেছিলে/ ও মিথ্যেবাদী মেয়ে/ তুমি তাকে মিথ্যে বলেছিলে/ কেন মিথ্যে বলেছিলে?'
লোকজ সুরও উপস্থিত রয়েছে সঞ্জীবের গানে। শাহ আবদুল করিমের গান 'গাড়ি চলেনা' সঞ্জীবের কণ্ঠে তুমুল জনপ্রিয় হয়। ফোকের সঙ্গে ব্যান্ডের চমৎকার এক মেলবন্ধনের উদাহরণ এই গান।
এছাড়া বলা যেতে পারে 'সাদা ময়লা' গানটির কথাও। 'সাদা ময়লা রঙিলা পালে, আউলা বাতাস খেলে/ আর কাদায় ভরা মনের মধ্যে জলের সন্তরণ' - লোকজ সুরে অসাধারণ কাব্যময় সঞ্জীবের লিরিক। তার সঙ্গে রূপক ব্যবহারে দার্শনিক প্রকাশ।
সঞ্জীব শুধুমাত্র বাজার কাটতির উদ্দেশ্যে গান করেননি কখনোই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে দাঁড়িয়ে জঙ্গিবাদ ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে গাওয়া 'স্বপ্নবাজি' অবিস্মরণীয়। 'আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া, সন্ধান করিয়া/ স্বপ্নের ওই পাখি ধরতে চাই / আমার স্বপ্নের কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই'- স্বপ্নবাজি গানের এই কথাগুলোর মতোই সঞ্জীব তার গানে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তরুণদের। বলতে চেয়েছেন নিজের স্বপ্নের কথা।
এই গানের আরেকটি জায়গায় বলছেন-' তিনটি লাশ, তিনটি লাশ/ ঠাণ্ডা হিম, যাদের গুম করে ফেলা হবে।' সে সময়ের ক্রসফায়ারের নামে চালু হওয়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সঞ্জীব তুলে আনতে পেরেছিলেন তার গানে।
সঞ্জীব আরো বলেছিলেন- ' মনে পড়ে, মনে পড়ে সেই হৃদয় কাঁপানো স্বপ্নের কথা/ কথা ছিলো নিশ্চিত বিজয়, কথা ছিলো/ সমান অধিকার কথা ছিলো/ ঘাড়ের ওপর চেপে বসা রক্তচোষার ঝাড়গুলোকে, নর্দমার কীটগুলোকে পায়ে পিষে মারার/ কথা ছিলো একদিন না হয় একদিন/ কোথায় যেন ভুল ছিলো/ সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনতে যারা বেরিয়ে পড়েছিল / তাদের কেউ আর ফিরে আসেনি, কেউ আর ফিরে আসেনি।' চারদিকে স্বপ্নভঙ্গের এত বেদনা-নৈরাশ্য, তবু হতাশা নয়, নিরুপায় হয়ে নয়, বরং সঞ্জীব প্রস্তুত হতে বলেছেন, করতে বলেছেন লড়াই৷ বিবর্ণ সময়কে রঙিন করার আহ্বান জানিয়েছেন তরুণদের প্রতি, তার গানে গানে। তাই মৃত্যুর পরের ১৬ টি অগ্রহায়ণ পেরিয়েও সঞ্জীব চৌধুরীকে ভীষণভাবে মনে পড়ে। হৃদয়ে-মস্তিষ্কে বাজে তার গান।