Published :
Updated :
রহমতের মাস পবিত্র রমজান প্রায় শেষ হওয়ার পথে। দরজায় কড়া নাড়ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে ঈদ নিয়ে হাজারো পরিকল্পনা।
ঈদে কোন পোশাক পড়ব, কোথায় ঘুরতে যাব, কিংবা খাবারের মেন্যু কেমন হবে- ইত্যাদি পরিকল্পনায় মত্ত পুরো দেশ। যারা জীবিকা কিংবা লেখাপড়ার কাজে পরিবার থেকে দূরে অবস্থান করেন তারাও ঈদের লম্বা ছুটিতে শেকড়ের টানে ছুটে যান পরিবারের কাছে।
আর তাই তো ব্যস্ততম রাজধানীতে যেখানে যানজট নিত্য দিনের সঙ্গী সেখানে এই সময়ের চিত্রটা থাকে পুরোপুরি ভিন্ন। কোথাও থাকে না কোনো যানজট কিংবা মানুষের ভিড়। তবে মুদ্রার যেমন এপিঠ-ওপিঠ থাকে, ঠিক তেমনি ঈদ উৎসবে কিছুদিন জিরিয়ে নেওয়া ঢাকা শহরেও থাকে এক ভিন্ন প্রতিচ্ছবি।
ঈদে পরিবার অথবা বন্ধুদের নিয়ে হাতিরঝিল, ফ্যান্টাসি কিংডম কিংবা নন্দন পার্কে না গিয়ে যদি কমলাপুর কিংবা খিলগাঁওয়ের রাস্তা দিয়ে কিছুটা সময় নিয়ে হেঁটে বেড়ান তাহলে দেখতে পাবেন ঈদের আনন্দ অনেকটাই ম্লান হয়ে আছে সেখানকার বস্তি কিংবা রাস্তার ধারে বসবাস করা ছিন্নমূলের বাসিন্দাদের কাছে। ঈদ তাদের নিকট কোনো আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে না। বরং তাদের রুটি-রুজির যেসব মাধ্যমগুলো আছে সেগুলোতেও ভাটা পড়ে ঈদ মৌসুমে।
কারণ এসব মানুষের বেশিরভাগই দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ কিংবা রেলওয়ের কুলি। আর জনশূন্য রাজধানীতে যেখানে ব্যস্ততম শহরটাও কাজ থেকে অবসর নিয়ে নেয়, সেসময় এদের কাজও প্রায় নেই বললেই চলে। তাই তো রুটি-রুজির মাধ্যমগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এমতাবস্থায় জীবন যাপন করাই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে ঈদ আয়োজন তাদের কাছে নিছক বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অথচ ঈদের প্রকৃত মাহাত্ম্য তখনই ফুটে ওঠে যখন আপনি আপনার পরিবার, আত্নীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশী সবার সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিবেন। সমাজের সবার খোঁজ-খবর নেওয়া এবং সকল হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে এক ছাদের নিচে মমতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাঝেই ফুটে ওঠে ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য।
মনে রাখবেন, সমাজের দরিদ্র এবং অবহেলিত জনগোষ্ঠী কিন্তু আমাদেরই সমাজেরই অংশ। তাদেরও পরিবার আছে, রয়েছে অন্তত ঈদের দিনটিতে পরিবারের সদস্যদের মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। সুতরাং তাদের প্রতি যদি বিত্তবানরা সদয় হয় তাহলে একদিকে যেমন তাদের মুখে হাসি ফুটবে, অন্যদিকে কমে আসবে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য।
বিষয়টিকে একটু অন্যভাবে দেখা যাক। বছরের অন্যান্য সময় কর্মব্যস্ত দিনগুলোতে অফিস কিংবা কর্মস্থলে যেতে অথবা আপনার নিত্য দিনের নানা দরকারে আপনাকে কিন্তু এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়।
কারণ এসব দিনমজুর, রিক্সাচালক, কুলি কিংবা অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষ আমাদের নিত্য দিনের কাজগুলোকে অনেক সহজতর করে তুলে। সুতরাং অন্যান্য সময়গুলাওতে যেখানে তাদের ছাড়া একটি দিনও চলা মুশকিল, সেখানে ঈদের দিনে তাদের ভুলে যাওয়া কি কোনো বিবেকবান মানুষের বৈশিষ্ট্য হতে পারে? এমন প্রশ্ন আমরা নিজেরাই নিজেদের করতে পারি।
এদেশে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। সতরাং চাইলেই আমরা ঈদের সময়টিতে দরিদ্র কিংবা ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়াই তাহলে আমাদের সমাজ হয়ে উঠবে আরো সুন্দর ও সহনশীল। এতে করে কমে আসবে সামাজিক বিভেদ।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সমাজে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। সহিহ মুসলিমে বলা হয়েছে, "রাসূল (সা.) বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তির অতিরিক্ত বাহন হিসেবে কোনো জন্তু কিংবা বাহনে খালি জায়গা থাকে, তাহলে সে যেন তা বাহনহীন ব্যক্তিকে দিয়ে সাহায্য করে। কোনো ব্যক্তির যদি অতিরিক্ত পাথেয় থাকে, সেক্ষেত্রে সে যেন পাথেয়হীন ব্যক্তিকে তা দিয়ে সহায়তা করে।" আর এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় ইসলামে দান-খয়রাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমেও অসহায় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীদের সেবা প্রদান করা হয়। কেউ চাইলে এসব সংগঠনের মাধ্যমেও সমাজের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। এমনই একটি সংগঠন হলো দূর্বার তারুণ্য ফাউন্ডেশন যারা শুধু ঈদেই নয়, বরং সারা বছরই অসহায় মানুষের সেবায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
এই প্রসঙ্গে কথা হয় দূর্বার তারুণ্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবু আবিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, "মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তির মনুষ্যত্ববোধ তখনই জাগ্রত হয় যখন তিনি অন্য মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন। আমাদের সমাজে অনেক দরিদ্র মানুষ রয়েছেন। সুতরাং মানুষ হিসেবে সেসব দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। পবিত্র রমজানে এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা যেমন ক্ষুধার যন্ত্রণা কেমন তা উপলব্ধি করতে পারি, ঠিক তেমনি আমাদের উচিত গরিব-দুঃখী মানুষের আর্থিক সামর্থ্যের দিকটিতেও দৃষ্টিপাত করা এবং সেই অনুযায়ী এগিয়ে আসা। তাহলেই ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে উঠবে।"
এই বিষয়ে আরো কথা হয় সাংবাদিক ও সমাজকর্মী তানভীর হোসাইনের সঙ্গে। তিনি বলেন, "ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করার চেয়ে সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সহযোগিতা করাটা অধিক ফলপ্রসূ হবে। বর্তমানে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারের তুলনায় অস্বচ্ছল পরিবারের সংখ্যা কিন্তু খুবই কম। সুতরাং আমরা চাইলে আমাদের সবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহযোগিতায় সম্মিলিতভাবে অসহায় ও আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারি যার মাধ্যমে ঈদের আনন্দকে সবার সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া সম্ভব হবে।"
ধনী-গরিব সবাই মিলেই একটি সমাজ গড়ে ওঠে। তাই যে কোনো উৎসব কিংবা বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আর তাই তো ঈদের মতো ধর্মীয় উৎসবগুলোতে সমাজের দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। এতে করে ঈদের মহিমা ছড়িয়ে পড়বে সবার মাঝে যা একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হবে।