Published :
Updated :
পুঁটি মাছের কাঙালি, ভাত মাছের বাঙালি—এসব কথা এখন শুধুই প্রবাদ। এক সময় দেশি প্রজাতির প্রচুর মাছ পাওয়া যেত দেশের নদী-নালা-খাল-বিলে। তবে এখন সেসব মাছ খুব বেশি দেখা যায় না। গত কয়েক দশকে দেশি প্রজাতির অনেক মাছই হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের উপকূলে মৎস্যভাণ্ডার নামে খ্যাত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের ৯টি উপজেলায় দেশীয় অর্ধশত প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। এখন আর পুকুরভরা মাছ নেই। জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসচেতনতা, অবাধে লবণপানি তুলে বাগদা চিংড়ি চাষ, ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং মিঠাপানির অভাবে মৎস্য খনি খ্যাত দক্ষিণাঞ্চলে অর্ধশত প্রজাতির মিঠাপানির দেশীয় মাছের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে।
সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন মিলছে না। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার শহর, বন্দর, গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই দেশীয় মাছের চরম সংকট। যা পাওয়া যায়, তার অগ্নিমূল্য। বিগত দিনে সরকারের উদাসীনতা, মৎস্য অধিদপ্তরের বাস্তবসম্মত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব এবং যে সকল প্রকল্প ও কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়া হয়েছিল, তার যথাযথ বাস্তবায়ন না করায় এ সেক্টরটি ‘শিকেয়’ উঠেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মৎস্য অধিদপ্তর এবং কয়েকটি এনজিও এসব বিষয়ে কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে তাও যৎসমান্য। জনসচেতনতা তৈরিতে দায়িত্বশীলরা এগিয়ে আসছে না।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, কয়েক দশক পূর্বেও এ অঞ্চলে আড়াই শত প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন চোখে পড়ে না। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমে নদী-খাল-বিল থেকে কারেন্ট জালের মাধ্যমে ব্যাপকহারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশীয় মিঠাপানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কালের গর্ভে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’র ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দুই দশক পূর্বেও বাগেরহাটের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মংলা, রামপাল, খুলনার রূপসা, তেরখাদা, দিঘলিয়া, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, কয়রা ও ফুলতলা এবং খুলনা সন্নিকটস্থ উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় আড়াই শত প্রজাতির মিঠাপানির মাছ পাওয়া যেত। যার মধ্যে শোল, টাকি, কৈ, গজাল, টেংরা, চিতল, শিং, খয়রা, বাটা, পাইশ্যা, কালিবাউশ, বাইল্যা, কাজলি, সরপুঁটি, পাবদা, খৈলশা, ডগরি, জাবা, ভোলা, বাগাড়, বাশপাতা, ভাঙ্গান, কাইন, দেশি পুঁটি, গোদা চিংড়িসহ অর্ধশত প্রজাতির মিঠাপানির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এ সকল মাছ স্বাদ ও পুষ্টিগুণে ছিল ভরপুর। এ অঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জের কয়েক শত হাওর, বাওড়, বিল, খাল, নদী থেকে এ সকল মাছ সংগ্রহ করত জেলে সম্প্রদায়। সারা বছর তারা মাছ শিকার করে নিজ পরিবারের চাহিদা পূরণসহ জীবিকা নির্বাহ করত। শুষ্ক মৌসুমে খাল, বিল, হাওরের পানি কমে গেলে চলত মাছ ধরার উৎসব।
বর্ষা মৌসুমের পূর্বে এপ্রিল মাস থেকে খাল, বিল, নদীতে মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। কারেন্ট জালের ব্যাপকতায় খাল, বিল, নদীতে এ মাছের রেনু ধরা পড়ে; এতে মাছের প্রজনন প্রচণ্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জালে ধরা পড়ে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার রেনু মাছ।
পরিবেশ ও মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য প্রজাতি বিলুপ্তির কারণ হচ্ছে—অপরিকল্পিতভাবে জলাধারে বাঁধ দেওয়ায় ভরা বর্ষা মৌসুমে ডিম ছাড়ার মা মাছ আসতে পারে না। মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা, তদুপরি খাল, বিল, হাওর, বাওড়গুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে, ফলে মাছের বংশবৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে পানি দূষণ, জলাশয়ের গভীরতা হ্রাস, ছোট মাছ ধরার জন্য কারেন্ট জালের ব্যবহার—এসব কারণে মৎস্য প্রজাতি ধ্বংস হচ্ছে। মারাত্মক পানি দূষণের কারণে আজ খুলনার ময়ূর নদী মাছের বংশবৃদ্ধি ও জীবনধারণের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য বাঁধ দিয়ে লবণপানির আধার নির্মাণের কারণে অনেক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে মৎস্যজীবী তথা সর্বসাধারণকে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তরের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও মৎস্য সংরক্ষণ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এটি রক্ষা করা সম্ভব।