Bangla
10 months ago

উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে প্রতিকূলতা জয় করেছেন যারা

Published :

Updated :

মানুষের জীবন একটা উপন্যাসের মতো যার বিভিন্ন অধ্যায়ে আছে হাজারো রকমের গল্প। হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতার এরকমই কিছু গল্প তৈরি হয় প্রতিবছর বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি যুদ্ধে। 

২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও রয়েছে এরকম কিছু অনুপ্রেরণার গল্প।

খাগড়াছড়ির এক ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে আসা হার না মানা সাহসী তরুণ অং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ বিভাগে ২১৫তম হয়ে আইন বিভাগ পড়ছেন।

শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩৬, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের খ বিভাগে ৩৬৩তম এবং ঘ বিভাগে ১৪৩৩তম হয়েছেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ আসলেও সমস্ত শর্ত পূরণ হওয়ায় আইন বিভাগে সুযোগ পান অং। তিনি বলে, "আমার উপজাতি কোটা আছে তাই চাইলে আমার প্রথমেই আসতো কিন্তু যখন দেখলাম মেধাতালিকায় আসছে, আমি আর কোটা ব্যবহার করিনি। কারণ হয়তো আমার কোটা ছেড়ে দেওয়ার কারণে আরো একজন সুযোগ পেতে পারে।"

অংয়ের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে টিলার ওপরে অবস্থিত রূপাইছড়ি সরকারি প্রাথমিকে বিদ্যালয়ে। এত দূরের ও বিপজ্জনক রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে পাঠাতে তার পরিবারও ভীষণ সংশয়ে থেকেছে সর্বদা।

অতঃপর প্রাথমিকের শিক্ষা শেষ করেই তার শুরু হয় এক অন্য সংগ্রাম। বাড়ির আশেপাশে নেই কোনো পড়ার মতো স্কুল। তাই বড় ভাইয়ের সাথে যেতে হয়েছে রামগড়ি হাইস্কুলে। ভাই চলে আসার পর অং এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় থাকতে শুরু করেন। বাসার ছোটদের দেখাশোনার বিনিময়ে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ মেলে। তারপর অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ঢাকায় ধানমণ্ডিতে একটি কলেজে পড়তে আসেন অং।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অংশ অং তখনো পর্যন্ত জানতো যে পড়াশোনার ব্যাপারটা হয়তো শুধু কলেজ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তার এক ভাইয়ের থেকে সে জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ও এর বিস্তৃতি সম্পর্কে।

কলেজে পড়ার সময় অং তার স্টুডেন্টের বাড়িতে থেকে রান্নাবান্নাসহ যাবতীয় কাজের বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পান।

 "অন্যের বাড়িতে থেকে তো আমি আমার ইচ্ছেমতো চলতে পারব না। আমাকে যখন যে কাজ করতে বলা হবে সেটা করার পরেই সুযোগ পেতাম নিজের পড়াশোনার। তবে যাদের বাড়িতে থেকেছি তারা আমার জন্য অনেকবেশি সহনশীল মনোভাবের ছিলেন। আমার পড়াশোনাতেও অনেক সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমি কোনো কোচিং করতে পারিনি; শুধু আমার ভাইয়ের বন্ধুর থেকে সহায়তা নিয়ে পড়েছি। আমার সাধারণ জ্ঞান, বাংলায় ভালো দক্ষতা থাকায় আমি বাড়তি সুবিধা পেয়েছিলাম।"

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে অং আরো বলেন, "আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আমার বাবা-মা বাড়ির গরু বিক্রি করে টাকা দিয়েছে। আমি একজন রাখাল, এখনো বাড়ি গেলে গরু চরাই। আমাদের সেই কষ্ট ও আদরে পালন করা গরু বিক্রি করে আমি এখানে পড়তে এসেছি। আমি অবশ্যই আমার বাবা-মাকে সুন্দর একটা জীবন দেব। যা তাদের জন্য আরও সুখের হবে।"

নেত্রকোণার ছেলে মো. মামুন মিয়া ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় খ ইউনিট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৮১তম হয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।

মামুন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। দুই বোন এবং বাবা-মায়ের সাথে তার ছোট্ট একটি পরিবার। বয়সের ভারে অসুস্থ পিতা ও গৃহিনী মায়ের সংসারের টানাপোড়েনে মামুন ও তার মেধাবী বোনদের করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম।

মামুন নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং ভালো ফলাফল করেন। কিন্তু একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগের টিউশন খরচের কথা ভেবে মানবিক শাখায় ভর্তি হন এবং এখানেও ভালো ফলাফল করেন।

তবে এই ভালো ফলাফলের জন্য মামুনকে করতে হয়েছে সংগ্রাম। নেত্রকোনা সরকারি কলেজে তার বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। আর এই দীর্ঘ পথ প্রতিদিন তাকে যাতায়াত করতে হয়েছে সাইকেল চালিয়ে। আর এসবের পেছনে ছিল তার বড়বোনের অবদানও।

মামুন বলেন, "আমি যেন পড়াশোনা করতে পারি সেজন্য আমার বড় আপা পড়াশোনা বাদ দিয়ে একবছর ঢাকা এসে গার্মেন্টসে কাজ করেছেন। আমার পরে এবার আপা তাই এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। আমি জানি আমার বড় আপা আর ছোট বোন দুইজনই কষ্ট করে হলেও একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে।"

অর্থাভাবে মানবিকে এলেও অর্থনীতি ও ইংরেজির মতো বিষয়গুলোকে কলেজের দুজন শিক্ষক স্নেহ করে বিনা বেতনেই পড়িয়েছেন।

"আমি এইচএসসি পরীক্ষার প্রথম থেকেই কলেজের পাশে মেসে থাকতে শুরু করি সেখানে দুটো টিউশন করিয়ে নিজের খরচ চালিয়েছি আর এডমিশনের প্রস্তুতি আমি আমার এলাকা থেকেই নিয়েছিলাম। আমার আর্থিক সমস্যার বিবেচনায় আমি সম্পূর্ণ ফ্রিতে কোচিং করে চান্স পেয়েছি এখানে।"

ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা হিসেবে মামুন জানান, "আমি ভবিষ্যতে একজন শিক্ষক হতে চাই এবং যদি সম্ভব হয় তবে আমার নেত্রকোনার কলেজে ফিরে গিয়ে সেখানেই শিক্ষকতা করব।"

শরীয়তপুরের মেয়ে মেহেরুন্নেসা। গৃহিনী মা ও ব্যবসায়ী বাবার ঘরের ছোট মেয়ে সে। ব্যক্তিজীবনে তেমন কিছুর অভাবও ছিল না তার, কেবল একটি জিনিস বাদে, সুস্থতা।

দীর্ঘ তিন বছর যাবত মেহেরুন থাইরয়েডের ক্যান্সারে ভুগছেন। সবুজবাগ সরকারি কলেজের ছাত্রী মেহেরুন তার এসএসসি পরীক্ষার আগে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে জানতে পারেন তার থাইরয়েড ক্যান্সারের কথা।

কোভিডের সময় নানা কারণে মেহেরুন্নেসা সঠিক চিকিৎসাও নিতে পারেননি, না পেরেছেন সময়মতো অপারেশন করতে।

দীর্ঘ সময়ের জটিল শারীরিক সমস্যা নিয়েই নিজেকে প্রস্তুত করেছেন মেহেরুন। ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ বিভাগে ৪৩০ তম এবং গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় ৭১তম স্থান অর্জন করে মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।

"আমি প্রায় তিনবছর যাবত ক্যান্সারে ভুগছি এবং আমাকে প্রতি বছরেই থ্যারাপি নিতে হয়। ডাক্তার বলেছে রিপোর্ট ভালো আসলে আমাকে আর থ্যারাপি নিতে হবে না। কিন্তু এ পর্যন্ত আমার রিপোর্ট খারাপই আসছে। এ অবস্থায় আমি সবসময় ভালোমতো পড়াশোনা করতে পারিনা এবং খুব দ্রুতই অসুস্থ হয়ে পরি। তবুও আমি ভর্তির সময় একদম রুটিন মেনে চলেছি। দ্রুত ঘুমানো, নিয়মমতো নিজের খেয়াল রাখা আর পড়াশোনা করেছি। অবশেষে আমার স্বপ্ন আমি জয় করতে পেরেছি।"

[email protected]

Share this news