
Published :
Updated :

এই পৃথিবীতে আছে নানান ভৌতিক স্থান। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখুন, পেয়ে যাবেন রহস্যময় এমন অনেক জায়গা। এমনই একটি স্থান পোভেগলিয়া দ্বীপ। ইতালির এই দ্বীপটির অবস্থান ভেনিশিয়ান লেগুনে ভেনিস ও লিডোর মাঝামাঝি।
এই দ্বীপটির আছে অন্ধকার ও রোমাঞ্চকর এক ইতিহাস। ১৮ ও ১৯ শতকে প্লেগ আক্রান্তদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিলো এই দ্বীপ। এরপর মানসিক রোগীদের জন্য অ্যাসাইলাম হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছিলো পোভেগলিয়াকে।
সমৃদ্ধ কৃষিভূমি থেকে প্লেগের দ্বীপ
পোভেগলিয়া একটি সুপ্রাচীন দ্বীপ। এর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। ৪২১ খ্রিষ্টাব্দে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। সে সময় রোমান সেনাদের প্রশিক্ষণস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো এটি। পরের কয়েক শতাব্দীজুড়ে কৃষিকাজ ও মাছ চাষের আকরে পরিণত হয় দ্বীপটি।
সে সময় কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়ের বসবাসের স্থান ছিলো সুজলা-সুফলা এই দ্বীপ। এখানে সবুজে ঘেরা প্রকৃতি নিয়ে আর নানান উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে দ্বীপটি হয়ে উঠেছিলো শান্তিময় আবাস। তেমনই চলছিলো কয়েকশ বছর ধরে। কিন্তু সুখের দিন আর চিরস্থায়ী হলো না। ১৮ শতকে হানা দেয়া বিউবোনিক প্লেগ বদলে দিলো সবকিছু।
কালো মৃত্যুর কবলে
বিউবোনিক প্লেগ পরিচিত ছিলো 'ব্ল্যাক ডেথ' বা কালো মৃত্যু নামে। এর সংক্রমণ হার ছিলো অতি উচ্চ। সে সময় ঝড়ের বেগে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ছিলো এই প্লেগ। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই পোভেগলিয়াকে পরিণত করা হয় একটি কোয়ারেন্টাইন স্টেশনে।
এই দ্বীপটি ভেনিসের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় জাহাজভর্তি রোগী নিয়ে এসে তাদের তোলা হতো এখানে। পোভেগলিয়া বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মনে করা হতো, এখানে ভেনিস থেকে রোগীদের এনে রাখলে বা একরকম নির্বাসন দিলে ইউরোপের বাদবাকি অংশে আর এটি ছড়িয়ে পড়বে না। তাই কারো ভেতর প্লেগের লক্ষ্মণ দেখা দিলেই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হতো এখানে।
'কিন্তু' রয়েই যায়
এই পরিকল্পনা তেমন কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। পোভেগলিয়ায় সুবিশাল দালান তৈরি করে রাখা হয়েছিল রোগীদের। একে বলা হতো 'লাজারেটোস।' লিঙ্গভেদে রোগীদের থাকার আলাদা জায়গা ছিলো। রোগ লক্ষণের তীব্রতা ভেদেও তাদের থাকার স্থান আলাদা করা হতো।
একপর্যায়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে রোগির সংখ্যা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত হয়ে পড়ে। এতে করে ভেন্টিলেশন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে রোগ আরো ছড়িয়ে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। এছাড়া চিকিৎসার ব্যবস্থাও তেমন ভালো ছিলো না। আদিকালের গাছ-গাছড়ার চিকিৎসা, আর নয়তো রক্তশোধনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হতো। এতে অনেকের সংক্রমণ আরো বাড়তে থাকে।
প্লেগ মারাত্মক রোগ হওয়ায় এখানে আসা রোগীদের বেশিরভাগই আর কখনো ফিরে যাননি। মৃতদের এখানেই কবর দেয়া হয়। ১৮ ও ১৯ শতকে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার রোগির মৃত্যু হয় এখানে। তাদের দ্বীপেই কবর দেয়া হয়। এর ফলে একপর্যায়ে দ্বীপে কবর দেয়ার জায়গার স্বল্পতা সৃষ্টি হয়। ফলে লাশ পোড়ানো ও দূরে ফেলে দিয়ে আসার ঘটনাও ঘটতে থাকে। এতে অনেক লাশ শেয়াল-শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়।
অমানবিক চিকিৎসাকেন্দ্র
প্লেগের প্রকোপ একসময় কমে আসে। তবে পোভেগলিয়া এরপরও ব্যবহৃত হতে থাকে চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবেই। ২০ শতকে মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসাকেন্দ্রে পরিণত করা হয় একে।
তবে মানসিক রোগের জন্য আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা এখানে ছিলো না। অমানবিক নানা উপায়ে চলতে থাকে মানসিক রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা। অগণিত রোগিকে নির্যাতন, উপেক্ষা এমনকি বর্বরোচিত উপায়ে কষ্ট দেয়া হতে থাকে। তাদের পেটানো, আঘাত করা, লম্বা সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন করে রাখার মতো বহু ঘটনা ঘটে।
এমন নানা প্রমাণ পরে উদ্ধার করা হয়েছে। অমানবিক এই চিকিৎসার ভেতর ছিলো ইলেক্ট্রোকনক্লুসিভ থেরাপি। এই প্রক্রিয়ায় রোগীর মস্তিষ্কে ইলেকট্রিক কারেন্ট পাঠানো হতো। এই পদ্ধতি 'সেইজার' নামেও পরিচিত ছিলো। এছাড়া 'লবোটোমিস' নামে আরেক ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতি। এর ফলে বহু রোগী নরক যন্ত্রণার সম্মুখীন হন। বহু রোগির মৃত্যু ঘটে। তাদের সমাধিও হয় এখানেই।
দ্বীপের অশরীরী: বাস্তব নাকি কল্পনা?
পোভেগলিয়ার এই অন্ধকার ও করুণ ইতিহাসের পাশাপাশি এ নিয়ে আছে নানান কিংবদন্তি। অনেকেই বলে থাকেন, দ্বীপটিতে আছে অশরীরীদের অস্তিত্ব। এমন শোনা যায়, গভীর রাতে দ্বীপে বিচরণ করে প্লেগে মারা যাওয়া সেসব মানুষদের আত্মা। দ্বীপে অবস্থান করে নির্যাতনের শিকার হওয়া, কষ্ট পেয়ে মারা যাওয়া সেসব মানসিক রোগিদের আত্মাও৷
অশরীরীদের দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে বহু মানুষের। এমনটি বহু লোক বলেছেন যে, পরিত্যক্ত ভবনগুলো (যা একসময় চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো) থেকে কান্না, চিৎকার, গোঙানো ও হাসির শব্দ তারা শুনতে পেয়েছেন। কোনো কোনো পর্যটক বলেছেন, দ্বীপে ঘোরার সময় অস্বস্তিকর এক অনুভূতি তাদের হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, অদৃশ্য কিছু একটা ধাক্কা দিয়েছে তাদের!
এতে রসদ জুগিয়েছে দ্বীপটির মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা ও বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত হয়ে থাকার ব্যাপারটি। এখানে পর্যটকদের আনাগোনাও খুব একটা নেই। তাই গা ছমছমে পরিবেশই বিরাজ করে এখানে।
পোভেগলিয়াকে নিয়ে রটে যাওয়া বহু গল্পই আসলে গুজব, নয়তো কিংবদন্তি। অতিপ্রাকৃত সত্ত্বার উপস্থিতির সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি। তবে যাদের তেমন অভিজ্ঞতা আছে, তারা দ্বীপে অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব সত্যিই আছে বলে বিশ্বাস করেন।
পোভেগলিয়ার ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল?
পোভেগলিয়ার এই অন্ধকার, চমকপ্রদ ইতিহাসকে ভিত্তি করে সেখানে পর্যটকদের রোমাঞ্চকর অনুভূতি প্রাপ্তির ও শিহরিত হবার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। অ্যাসাইলামটি বন্ধ হবার পর, দ্বীপটি একরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে দ্বীপটির স্থাপনাকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' আখ্যায়িত করে এখানে পর্যটকদের আগমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ফাঁক-ফোকর দিয়ে কেউ কেউ ভূতের সন্ধান পাবার জন্য ঢুকে পড়েন এই দ্বীপে, যদিও তা একেবারেই বেআইনি। তবে সম্প্রতি পরিত্যক্ত এই দ্বীপটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও, এতে স্থানীয় রক্ষ্মণশীল অধিবাসীদের আপত্তি রয়েছে।
একদা যে দ্বীপ ছিলো কলতানে মুখর, সেই দ্বীপটি পরে হয়ে পড়েছিলো রোগ-শোকে মৃত্যুপুরি। তবে এখনও সুযোগ আছে দ্বীপটিকে আবারো পর্যটকদের জন্য গড়ে তোলার। বহু মানুষের পদধূলি দ্বীপটিতে পড়তে থাকলে তখন হয়তো কথিত অশরীরীরা লুকোবেন। কিংবা, কে বলতে পারে, হয়তো পর্যটকদের ভিড়ে তারাও ঘুরবেন দ্বীপময়, কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে।
mahmudnewaz939@gmail.com

For all latest news, follow The Financial Express Google News channel.