Published :
Updated :
একাধারে শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক, আইনজীবী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, জ্ঞানতাপস ও ভাষাসৈনিক হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের মনে জায়গা করে নেয়া অন্যতম বাঙ্গালী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র আজ ১৩৯তম জন্মদিন। তার এই জন্মবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২৪ পরগণার পেয়ারা গ্রামে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম ১৮৮৫ সালের ১০ই জুলাই। তার নাম জন্মের সময় রাখা হয়েছিল শেখ মুহম্মদ ইব্রাহিম। কিন্তু তার মা হুরুন্নেসা ছেলের নাম পরিবর্তন করে রাখেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সেই নামেই তিনি সর্বত্র পরিচিত। বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন মধ্যযুগীয় পীর গোরাচাঁদের দরবার শরিফের খাদেম।
শিক্ষা জীবনে তিনি কখনোই পিছিয়ে ছিলেন না। জ্ঞানলাভের প্রতি নিষ্ঠা এবং ভালোবাসা থেকেই পড়ালেখার সকল ধাপ তিনি যথাসময়ে সম্পন্ন করেন। প্রথমে গ্রামের মক্তব, হাওড়া জিলা স্কুল, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। জ্ঞান অর্জনের প্রতিটি ক্ষেত্র তাকে ভাষার প্রতি আরও আগ্রহী করে তোলে। চাকরিতে যুক্ত হওয়ার পর তিনি ফের ভাষাতত্ত্বেই উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ফ্রান্সে যান এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত, বৈদিক ও প্রাকৃত ভাষার ওপর পড়াশোনা করেন। পরবর্তীকালে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ধ্বনিতত্ত্বে গবেষণার জন্য প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট।
তার কর্মজীবনও ছিল জাঁকজমক ও রঙিন। সীতাকুন্ড হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে, বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব, নিজ এলাকায় আইন ব্যবসা, গবেষণাসহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলেন তিনি।
অতঃপর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাথে সাথেই সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগ দেন এই ভাষাবীদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি এতটাই ভালোবেসে ফেলেন যে, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরম ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও শান্তি নিকেতন থেকে শিক্ষক হওয়ার আমন্ত্রণও গ্রহণ করেননি। আরও একটি মজার তথ্য হলো তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন।
তার জ্ঞানের গরিমা সবাইকে অবাক করে তুলতো যে কারণে তাকে বলা হতো ‘চলন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া বা চলন্ত অভিধান’। বিভিন্ন ভাষার প্রতি ছোটবেলা থেকেই ছিল তার অদম্য আগ্রহ।
তাই একে একে প্রায় ২৪-২৮টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি তিনি শৈশবেই আত্মস্থ করেছিলেন। এছাড়াও, পাহ্লবী, খোতনি, পালি, ইংরেজি, লাতিন, আরবি, উর্দু, ফারসি, তিব্বতি, জার্মানি, ফরাসি, হিব্রু, গ্রিক, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, সিংহলি, সিন্ধিসহ প্রায় আরো ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন এই ভাষাবীদ। তার ভেতর ১৮টি ভাষা নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। এসকল ভাষায় তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল এবং সেই ভাষাগুলোতে তিনি অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন বলেও জানা যায়।
পাঠ্যবই-এ বাংলা ভাষার ইতিহাসে শিশুরা যা পড়ছে তার অধিকাংশই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র গবেষণার ফল। তার জীবদ্দশায় বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
পাকিস্তান সরকার যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ই তখন ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে এই বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম যুক্তি-তর্ক দিয়ে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বিবেচিত করার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও, সেসময়ের বিভিন্ন সেমিনার ও সভা-সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সামনে।
মনে প্রাণে ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন প্রকৃত উদাহরণ। তার বিখ্যাত বাণী, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালীত্বের এমন ছাপ এঁকে দিয়েছেন যে মালা তিলক টিকিতে বা টুপি লুঙ্গি দাঁড়িতে তা ঢাকবার জো নেই’।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? শীর্ষক একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। আর এই ২০ জনের তালিকায় ১৬তম স্থানে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
প্রাচ্যের অন্যতম সেরা এই বাঙ্গালীর আজ ১৩৯তম জন্মদিন। জীবদ্দশায় তিনি শিক্ষক হিসেবেই নিযুক্ত ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তবে তিনি আরো যুক্ত ছিলেন একাধিক মাসিক, ষাণ্মাসিক পত্রিকার সাথে, এর মধ্যে আল-ইসলাম পত্রিকা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, আঙ্গুর, দি পীস, তকবীর ও বঙ্গভূমি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রচনা করেছেন গবেষোণা গ্রন্থ, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ইত্যাদি।
জীবনে এই অসাধারণ সব কৃতিত্বের জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ পেয়েছেন অসংখ্য উপাধি, পদক ও পুরস্কার। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মরণোত্তর ‘ডি লিট’ উপাধি, মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদক’, ফ্রান্স সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত ‘নাইট অব দ্য অর্ডার অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স’ উপাধি, ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ পদক, মরণোত্তর ‘হেলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’ প্রভৃতি।
বহুভাষাবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার এই বিশাল কর্মময় জীবন ১৩ই জুলাই ১৯৫৯ সালে শেষ হয়। জন্মাস্থান থেকে বহুদূরে তবে বাংলার মাটিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশে মুসা খান মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তিনি সমাধিস্থ হন। তার মৃত্যুর পর ওই বছরই ভাষার প্রতি অসামান্য অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসময়ের ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল।
মসজিদ, তাঁর প্রিয় কর্মস্থল, প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন এবং যার কাছেই রয়েছে ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনার সেই প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেই পরম শান্তিতে তিনি শায়িত।
afranawmi@yahoo.com