Published :
Updated :
বিশ্ব রক্তদাতা দিবস ১৪ জুন। দিনটি মূলত লক্ষ লক্ষ উদার, স্বেচ্ছাসেবক ও মানবিক রক্তদাতাদের প্রতি ধন্যবাদ জানানোর উপলক্ষ, যারা নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে অসংখ্য মুমূর্ষু মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। নিরাপদ রক্ত নিশ্চিতকরণ এবং স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের উৎসাহিত করতেই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় এই দিনটি। এবারের প্রতিপাদ্য—‘Give blood, give hope: together we save lives’, যার সহজ বাংলা অর্থ ‘রক্ত দিই, আশা জাগাই : সবাই মিলে জীবন বাঁচাই’। দিবসটি উপলক্ষে রক্তদাতা ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা নিরাপদ ও নিয়মিত রক্তদানের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
সাধারণত থ্যালাসেমিয়া ছাড়াও রক্তস্বল্পতা, প্রসূতির রক্তক্ষরণ, অগ্নিদগ্ধ রোগী, বড় অপারেশন, দুর্ঘটনা ইত্যাদি নানা কারণে রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্তের কোনো বিকল্প নেই। রক্তের প্রয়োজনে রক্তই দিতে হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে আপাত সুস্থ ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যেকোনো সক্ষম ব্যক্তি প্রতি চার মাস পরপর রক্ত দিতে পারেন। নিয়মিত রক্তদানে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণেরও বেশি কমে যায়। এমনকি আত্মিক-আধ্যাত্মিকভাবেও এর উপকার লাভ করেন দাতা।
আমাদের দেশে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের ওপর নির্ভরতা দিন দিন কমছে, স্বজনদের দানের পরিমাণও বেড়েছে। তবে প্রয়োজনীয় রক্তের চাহিদা আমরা এখনও মেটাতে পারছি না। অথচ রক্তদানের জন্যে ঐকান্তিক ইচ্ছাই যথেষ্ট। ধর্মীয়ভাবেও এ দান অত্যন্ত পূণ্যের কাজ। আর সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে রক্তচাহিদা পূরণে সঙ্ঘবদ্ধ সচেতনতাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। একটি জনগোষ্ঠীর অল্প কিছু অংশ সামর্থ্যবান মানুষ যদি নিয়মিত রক্তদান করেন তাহলেই রক্তের অভাবে কোনো মানুষের মৃত্যু হবে না। নিয়মিত ছোট্ট এই দান নতুন করে হাসি ফোটাতে পারে লাখো মানুষের জীবনে।
আমাদের দেশে রক্তদাতা দিবস উপলক্ষে রক্তচাহিদা পূরণে মানবিক আবেদন জানিয়ে সরব রয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, রেড ক্রিসেন্ট, সন্ধানী, বাঁধনসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। ব্লাড ল্যাবগুলো উৎসাহিত করছে ল্যাবে গিয়ে রক্তদানে। এতে করে এক ইউনিট রক্তকে একাধিক উপাদানে ভাগ করে একাধিক রোগীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে বছরে রক্তের চাহিদা আনুমানিক ১০ লক্ষাধিক ইউনিট। অথচ দেশের জনসংখ্যার তুলনায় রক্তের এ চাহিদা একেবারেই নগণ্য। তা হলেও এখনও আমরা স্বেচ্ছা রক্তদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারিনি। রক্তের প্রয়োজন মেটাতে যেহেতু কেবল রক্তই দিতে হয়, সেহেতু ব্যাপক জনসচেতনতার মাধ্যমে স্বেচ্ছা রক্তদাতা বৃদ্ধিই রক্তের এ চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায়।
রক্তদানে দাতার উপকার
একজন রক্তদাতা রক্তদানের মাধ্যমে পেতে পারেন নানা উপকার। রক্ত দিলে শারীরিকভাবে মেরুমজ্জার রিজুভিনেশন বা স্টিমুলেশন হয়, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে দ্বিগুণেরও বেশি, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমাসহ থামিয়ে দেওয়া যায় বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। সামাজিকভাবে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো, রক্ত নিয়ে ব্যবসা কমানো, সমাজে ঘাতক রোগের বিস্তার কমানো এবং সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন বৃদ্ধি করতেও রক্তদানের ভূমিকা রয়েছে। রক্তদানের মাধ্যমে বিনা খরচে ‘ভালো আছি’—এই তৃপ্তিবোধ ও অপার আনন্দের অনুভূতি উপভোগ করা যায়।
যারা রক্ত দিতে পারবেন না
সাধারণত ৫টি টিটিআই বাহক, থ্যালাসেমিয়ার রোগী, লিউকেমিয়ার রোগী, হাইপোপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, হিমোফিলিয়া, হৃদরোগ, স্নায়ুবিক রোগ, থাইরোটক্সিকোসিস, এমফাইসেমা, ইনসুলিন নির্ভর (টাইপ-১) ডায়াবেটিস রোগীরা রক্তদান করতে পারবেন না।
এক ব্যাগ রক্তে বাঁচুক একাধিক প্রাণ
রোগভেদে একেক রোগীর জন্যে রক্তের একেক উপাদান লাগে। রক্তদানের পরপরই উন্নত প্রযুক্তির মেশিনে রক্ত উপাদানগুলো যথাযথভাবে পৃথক করা গেলে এটি সম্ভব। এক্ষেত্রে রক্তদাতাকে সরাসরি ল্যাবে গিয়ে রক্তদান করতে হবে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মতো উন্নত ল্যাবে নিরাপদ ও দ্রুত সেবাদানের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে এক ব্যাগ রক্তকে ৮টি উপাদানে আলাদা করার ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন;
১. প্লাটিলেট কনসেনট্রেট
২. ফ্রেশ প্লাজমা
৩. ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা
৪. প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা
৫. প্লাটিলেট পুওর প্লাজমা
৬. প্রোটিন সলিউশন
৭. রেড সেল কনসেনট্রেট
৮. ক্রায়ো-প্রিসিপিটেট
তার মানে, এক ব্যাগ রক্তকে একাধিক রোগীর প্রয়োজনে ব্যবহার করা সম্ভব।
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মহৎ সৎকর্ম
সকল ধর্মেই মানব কল্যাণ একটি বড় এবাদত। রক্তদান উত্তম সৎকর্ম। স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনে এটি ভালো কাজের অন্যতম উদাহরণ। পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “যখন কেউ নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যখন কেউ কোনো মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করল।” বাইবেলে বলা হয়েছে, “সৎকাজ সম্পর্কে জানার পরও তা থেকে বিরত থাকা পাপ।” (যাকোব ৪:১৭)। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, নিঃশর্ত দানের জন্য রয়েছে চমৎকার পুরস্কার। তারা লাভ করে আশীর্বাদধন্য দীর্ঘজীবন ও অমরত্ব।
বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে স্বেচ্ছা রক্তদাতা সকল বীরদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা।