বিনিয়োগ আকর্ষণে ১২ বাধা, ১৫ সুপারিশ
চীনা এফডিআই ও রপ্তানি বৃদ্ধির প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ
Published :
Updated :
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাণিজ্য সক্ষমতা বৃদ্ধির বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ চীনের সম্ভাব্য উচ্চমাত্রার বিনিয়োগ গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সরকারি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য রূপান্তরমূলক ভূমিকা রাখতে পারে। বৈশ্বিক শ্রমব্যয় বাড়া ও বাণিজ্য পরিবেশের পরিবর্তনে চীন থেকে পোশাক শিল্পের কারখানা সরিয়ে আনার সম্ভাবনায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে।
গোপনীয় ওই প্রতিবেদনটির কপি দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের হাতে এসেছে। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান দৈনিকটিকে জানান, "বেশিরভাগ বিষয় সম্পর্কে সরকার অবগত। চীনা এফডিআই বাড়াতে আমরা আগ্রহী।"
প্রতিবেদনটিতে চীনা বিনিয়োগ প্রবাহের পথে ১২টি বড় অন্তরায়ের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অনিশ্চিত করনীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, জ্বালানি ঘাটতি, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক মিত্রতার পরিবর্তন।
বিনিয়োগ আকর্ষণে ১৫টি করণীয় সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগনীতিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠন, চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ রপ্তানিতে ইউয়ান মুদ্রা ব্যবহারের অনুমোদন, স্থিতিশীল কর কাঠামো এবং খাতভিত্তিক বিনিয়োগ কৌশল প্রণয়ন।
রপ্তানি সম্ভাবনা: মাত্র ১% শেয়ারেও ২৬ বিলিয়ন ডলার
চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি বর্তমানে দেশটির মোট আমদানির মাত্র দশমিক শূণ্য ৪ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অংশ যদি ১ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তবে বছরে ২৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় সম্ভব। ২০১৮ সালের যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া লাভবান হলেও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ে। এবার সরকারকে আরও সক্রিয় হতে বলা হয়েছে।
উচ্চ সম্ভাবনাময় খাত: কৃত্রিম তন্তু, খেলনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি
প্রতিবেদনে সম্ভাবনাময় খাতের তালিকায় রয়েছে কৃত্রিম তন্তু, খেলনা, প্লাস্টিক, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ফিনটেক, সেমিকন্ডাক্টর এবং ইলেকট্রনিকস। তৈরি পোশাক খাত এখনও তুলার ওপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক বাজারের ৭০ শতাংশ এখন কৃত্রিম তন্তুভিত্তিক। তাই কৃত্রিম তন্তু উৎপাদনে চীনা বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ।
প্লাস্টিক এবং খেলনা খাতে প্রযুক্তি স্থানান্তর, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের আম রপ্তানির অনুমোদন এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য ও ইলিশ রপ্তানিতেও আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। এতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ ও পচনরোধে বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ৪০% লক্ষ্যমাত্রা
বাংলাদেশ ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। এই খাতে চীনা প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি পাটখাত, ওষুধশিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ডিজিটাল অর্থনীতি, অবকাঠামো, টেলিযোগাযোগ, আইসিটি, পর্যটন, জাহাজভাঙা, রান্নাঘর সরঞ্জাম এবং আসবাব খাতেও সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা: করনীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও জ্বালানি সমস্যা
তবে এ সম্ভাবনার বিপরীতে জটিলতা নানাবিধ। হঠাৎ করনীতি পরিবর্তন, ডলার সংকটে মুনাফা ফেরত পাঠানোর বিলম্ব, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও সমন্বয়হীনতা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, ভাষাগত দুর্বলতা, বন্দর-যোগাযোগ সমস্যা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বৈশ্বিক মিত্রতার চাপ বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাস্তবায়ন বিলম্ব, গ্যাস-বিদ্যুতের ঘনঘন বিঘ্ন, বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ না থাকাও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশ
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে করনীতির স্থিতিশীলতা, কাস্টমস ও জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করা, খাতভিত্তিক কৌশল নির্ধারণ এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ডলারের সংকটে মুনাফা ইউয়ানে পাঠানোর অনুমতি, সরাসরি ফ্লাইট চালু, চীনা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু, যৌথ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, বিনিয়োগনীতিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং বেসামরিক প্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে।
বিআইডিএ, বেজা, বেপজা ও হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে একীভূত করে একক প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রস্তাবও রয়েছে।
এছাড়া শক্তিশালী আর্থিক সংস্কার, বিদেশি বিনিয়োগ প্রকল্পে দুর্নীতি-প্রতারণা দমন এবং ইতিবাচক আন্তর্জাতিক প্রচারণার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
আরসিইপি সদস্যপদ ও প্রবাসীদের বিনিয়োগ আকর্ষণ
বাংলাদেশকে আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য জোট আরসিইপিতে যোগদানের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্ধারণের প্রস্তাব রয়েছে।
newsmanjasi@gmail.com