Published :
Updated :
সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, গানে কিংবা কবিতায়, বাঙালির জীবনে নৌকা নেই কোথায়? একসময়ের অতি পরিচিত বাহন নৌকা এখন বিলুপ্তির পথে।
নদী প্রধান এই দেশে যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল নৌকা। প্রাচীন কাল থেকেই তাই নৌকা নিয়ে চলেছে নানা গবেষণা, তৈরি করা হয়েছে নানা ধরনের নৌকা। আবার এলাকা ভেদে তাদের নামও দেয়া হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন।
একসময় গাছের আস্ত গুঁড়ি খোদাই করে গোলাকার ফাঁকা স্থান সৃষ্টি করে নৌকা বানানো হতো। এরপর বেত, বাঁশ, চামড়া এবং কাঠের আঁটি বেধে নৌকা তৈরি হতো। আর মাঝখানের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে গাব গাছের কষ ব্যবহার করা হতো।
বর্তমানে ফেরোসিমেন্ট ও ফাইবার গ্লাসের মতো আধুনিক উপকরণ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হয়। তবে সাধারণত শাল, সেগুন, সুন্দরী, বার্মা সেগুন প্রজাতির কাঠ নৌকা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের নৌকা দেখা যায়। নৌকার মাঝির নামও নানা সময়ে নানা রকম ছিল। যেমন: ভাগী, সাজী, গলইয়া, ডাকুয়া, দাড়ি, খেয়া ঘাটের মাঝি, ইত্যাদি।
ডোঙা: তালগাছের গুঁড়ি কুঁদে এই নৌকাটি তৈরি হয়। এই নৌকার প্রস্থ এতো কম যে পাশাপাশি দুই জন বসা যায় না।আর এটি চালাতে একটু অসতর্ক হলেই উলটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কোষা: এটি পারিবারিক নৌকা। বর্ষাকালে এটি স্বল্প দূরত্বের পারাপারের জন্য ব্যবহৃত হয়। ৮ জন যাতায়াত করতে পারে এই নৌকায়। এটি ওজনের ভারী এবং ছইবিহীন একটি নৌকা।
সাম্পান: লোকগীতি কিংবা সাহিত্যে সাম্পানের নাম আমরা শুনেছি। এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। উত্তাল সমুদ্রে চলাচলের জন্য এটি উপযোগী একটি বাহন। নৌকাটির সামনের দিকটা উঁচু, বাঁকানো এবং পেছনটা সোজা। এতে পাল থাকে।
গয়না: মাঝারি আকৃতির এই নৌকা এক সময় কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে যাত্রী পারাপারের জন্য ব্যবহৃত হতো। ২৫-৩০ জন বসতে পারত একটি নৌকাতে। এই নৌকাটিও এখন বিলুপ্ত।
বজরা: ধনিক বা জমিদার শ্রেণির লোকেরা শখ করে এই নৌকা নিয়ে ভ্রমণে যেতেন। এতে চারজন মাঝি থাকত। নৌকাটিতে খাবার, পানীয়ের ব্যবস্থা থাকত; সিরাজগঞ্জ পাবনা অঞ্চলে বেশি দেখতে পাওয়া যেত।
বাইচের নৌকা: এই নৌকাটি প্রতিযোগিতার জন্য ব্যবহৃত হয়। আগেকার দিনের রাজা, বাদশাহরা এই খেলার আয়োজন করত। আকারে এটি ১৫০-২০০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। নৌকাটি চালানোর জন্য আকারভেদে ২৫-১০০ জন মাঝির প্রয়োজন হয়। বজরার আরো কিছু সুন্দর নাম রয়েছে। যেমন- পঙ্খীরাজ, ঝড়ের পাখি, সোনার তরী, দ্বীপরাজ, ইত্যাদি। এই নৌকাটি কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেশি দেখতে পাওয়া যেত।
পাতাম: এটি একটি যুগল নৌকা। একে জোড়া নাও ও বলা হতো। মূলত মালামাল পরিবহনের জন্য বিশেষ কায়দায় দুটি নৌকাকে একসাথে যুক্ত করে তৈরি হয় পাতাম। ফলে একটি নৌকা মাঝি ছাড়াই চলতে পারে। এটি সিলেট ও কিশোরগঞ্জে দেখা যেত।
পানসি: এই নৌকাগুলোতেই মুর্শিদি, মারফতি ও ভাটিয়ালি গান গাওয়া হতো।
ময়ূরপঙ্খী: এটি ২ পাল বিশিষ্ট সৌখিন নৌকা, চালাতে ৪ জন মাঝি প্রয়োজন। অতি সুন্দর এই নৌকাটিও এখন বিলুপ্ত।
নৌকার ব্যবহার ক্রমশ কমে আসলেও গত কয়েক বছর ধরে নৌকার অন্য রকম প্রচলন দেখা যাচ্ছে। পর্যটনশিল্পের হাত ধরে নৌকা আবার ফিরে আসছে। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের প্রায় ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর আছে। এসব হাওরে পর্যটকদের বড় আকর্ষণ নৌকা।
ভরা পূর্ণিমায় হাওরে রাত কাটানো যে কারো জন্যই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এই নৌকাগুলোতে রয়েছে থাকার জন্য কেবিন, ওয়াশরুম, খাবার ও পানির সুব্যবস্থা। এছাড়াও নৌকাগুলো টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আশেপাশের দর্শনীয় স্থান, যেমন - নীলাদ্রি লেক, জাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, চানপুর ঝরনা দেখারও ব্যবস্থা করে দেয়।
কিশোরগঞ্জের নিকলি ও মিঠামইন হাওরেও বর্তমানে এসব নৌকায় ছাতির চর সহ নানা স্থানে ভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও ঢাকার সদর ঘাট থেকেও বর্তমানে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্থানে যাতায়াতের জন্য লাক্সারি বোটের ব্যবস্থা রয়েছে।
বর্তমানে নতুন রূপে ফিরে আসা নৌকার কল্যাণে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা হচ্ছে, তৈরি করছে কর্মসংস্থান। বাঙালি সংস্কৃতির অংশ এই বাহন যেন হারিয়ে না যায়, সেটিই আশা সকলের।
নাওশিন মুশতারী, দ্বিতীয়বর্ষে অধ্যয়নরত, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।