Bangla
2 days ago

পায়রা বন্দরের ৪,৬৬২ কোটি টাকার প্রকল্প একনেক অনুমোদনের অপেক্ষায়

ফাইল ছবি।
ফাইল ছবি।

Published :

Updated :

পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে পায়রা বন্দরের ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রাবনাবাদ চ্যানেলে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের জন্য আরও ৩ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এই চ্যানেল সমুদ্র মোহনা থেকে দূরে হওয়ায় চলাচলের উপযোগিতা বজায় রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং প্রয়োজন হয়।

এছাড়াও, দীর্ঘমেয়াদে নাব্যতা রক্ষায় নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের জন্য ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ‘হপার ড্রেজার’ কেনা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এ লক্ষ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ‘পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং এবং হপার ড্রেজার সংগ্রহ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মোট আনুমানিক ব্যয় ৪ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা, যার আওতায় ড্রেজিং কার্যক্রম, ড্রেজার সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।

একজন জ্যেষ্ঠ পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বুধবার প্রকল্পটির প্রাক্‌মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) বৈঠকে পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশ সাপেক্ষে এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তিনি আরও জানান, এই মাসেই দুটি পৃথক পিইসি বৈঠকে পায়রা বন্দরের ডিজিটালাইজেশন (প্রায় ১৬১ কোটি টাকা) এবং কর্মকর্তাদের আবাসন সুবিধা নির্মাণ (প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা) বিষয়ক আরও দুটি প্রকল্প পর্যালোচনা করা হবে।

এই তিন প্রকল্প অনুমোদন পেলে পায়রা বন্দরের জন্য আগামী তিন বছরে মোট ৫ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয় হবে, যা বর্তমান প্রকল্পের বাইরের অতিরিক্ত ব্যয়। পুরো অর্থই সরকারি নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।

এর আগে, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি উন্নয়ন প্রকল্প ও রাজস্ব কর্মসূচির অধীনে মূল ড্রেজিং এবং চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণে মোট ৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

তবে, এত বিপুল ব্যয় সত্ত্বেও চ্যানেল এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে নাব্য না হওয়ায় নতুন ড্রেজিং প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডাররা।

পিইসি সভায় বলা হয়, প্রকল্পটি একনেকে পাঠানোর আগে বন্দরের রাজস্ব ও ব্যয়ের বিস্তারিত বিশ্লেষণ এবং নতুন ড্রেজিং থেকে সম্ভাব্য আয় সংযুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

এর আগে মার্চ মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পায়রা বন্দরের উচ্চ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও সীমিত কার্যকারিতা উল্লেখ করে একে “অর্থনীতির জন্য বিষ” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

তিনি বলেন, বন্দরটি চালু রাখতে প্রতিবছর দুটি ড্রেজার প্রয়োজন হবে, মূলত পাশের বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা আমদানির জন্য। পায়রা বন্দর আসলে একটি সমুদ্র বন্দর নয়, বরং ছোট জাহাজের জন্য একটি ঘাট। 

তিনি বাজেট পরবর্তী ব্রিফিংসহ বিভিন্ন সভায় এই প্রকল্পকে ভুল সরকারি বিনিয়োগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তবে পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, সাইট পরিদর্শনের পর অধ্যাপক মাহমুদ পরামর্শ দেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ভূরাজনৈতিক কারণে চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দর বন্ধ হয়ে গেলে পায়রা বন্দর বিকল্প হিসেবে ব্যবহারযোগ্য করা যেতে পারে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত নতুন ড্রেজিং প্রকল্পটি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করবে। এতে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রাবনাবাদ চ্যানেলে ১০.৫ মিটার গভীরতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুটি ট্রেইলিং সাকশন হপার ড্রেজার সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে।

কর্মকর্তারা জানান, এর উদ্দেশ্য হলো ৪০ হাজার ডেডওয়েট টন (ডিডব্লিউটি) ধারণক্ষমতাসম্পন্ন পানাম্যাক্স শ্রেণির বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা।

তবে এই প্রকল্প এমন একটি সময়ে প্রস্তাব করা হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি, কমে আসা উন্নয়ন সহায়তা এবং বাড়তে থাকা রাজস্ব ঘাটতির চাপ মোকাবেলা করছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অতীতে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় ও অপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ দেখা গেছে, যার প্রতিফলন এখন অর্থনীতিতে পড়ছে।

তিনি বলেন, এত বিনিয়োগ করা হয়েছে, বন্দর আংশিকভাবে চালুও আছে। একে যদি এখন পরিত্যাগ করা হয়, তাহলে পূর্ববর্তী সব ব্যয়ই অপচয় হবে। তাই অবশিষ্ট অবকাঠামো অত্যন্ত খরচ-সাশ্রয়ী উপায়ে নির্মাণ করতে হবে এবং বন্দরটির ব্যবহার সর্বোচ্চ করে তুলতে হবে।

একজন স্থানীয় গবেষণা সংস্থার বাজেট বিশ্লেষক বলেন, যখন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জলবায়ু অভিযোজন খাতে অর্থের অভাব, তখন প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ড্রেজিংয়ে ব্যয় করাকে অগ্রাধিকারের ভুল বলে মনে হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা উপসর্গের চিকিৎসা করছি, মূল কারণের নয়। তাহলে দীর্ঘমেয়াদি পলি ব্যবস্থাপনা কৌশল বা টেকসই বন্দর উন্নয়ন পরিকল্পনা কেন নেই? 

সরকারি নথিপত্রেই বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের এপ্রিলের পর যদি রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং বন্ধ থাকে, তবে চ্যানেল আবারও পলিতে ভরে যাবে এবং পূর্বের মূলধনী বিনিয়োগ হবে নিষ্ফল।

পায়রা বন্দরের ড্রেজিংয়ের ইতিহাস দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল। ২০১৩ সালে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর থেকেই এটি ক্যাপিটাল এবং রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের উপর নির্ভরশীল।

প্রাথমিক মূলধনী ড্রেজিং চুক্তিটি প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ মডেলে বেলজিয়ান প্রতিষ্ঠান ‘জান দে নুল’-কে দেওয়া হলেও পরে আর্থিক জটিলতার কারণে এটি সরকারি অর্থায়নে রূপান্তর করা হয়।

শুধুমাত্র ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা।

এছাড়া, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ‘রাবনাবাদ চ্যানেলের জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, যার ব্যয় ছিল ৪১৩ কোটি টাকা।

৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা সত্ত্বেও বন্দরের নিজস্ব ড্রেজিং সক্ষমতা এখনও নেই, ফলে নাব্যতা বজায় রাখতে নতুন করে ড্রেজার কিনতে হচ্ছে। সমালোচকদের মতে, মূল প্রকল্পেই এ সমস্যার সমাধান করা উচিত ছিল।

jahid.rn@gmail.com 

Share this news